পারিবারিক আর্থিক অনটনের কারণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। রাজধানীর ইসলামপুরে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাপড় বিক্রির মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। এরপর ১৯৭৬ সালে নিজের ব্যবসা শুরু করেন এবং ১৯৮৭ সালে বড় ছেলের নামে প্রতিষ্ঠা করেন নোমান গ্রুপ। বর্তমানে এ গ্রুপের অধীনে রয়েছে ৩২টি প্রতিষ্ঠান ও কারখানা।
নুরুল ইসলামের জীবন ছিল সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। মাত্র ৬৭ টাকা হাতে নিয়ে ১৯৬৮ সালে ঢাকায় আসেন তিনি। খিলগাঁওয়ের একটি মেসে ১৫ টাকার মাসিক ভাড়ায় থাকতেন। তখন পণ্য বিক্রি করে মাসে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন আয় করতেন। দিনের পর দিন দোকানে দোকানে ঘুরে পণ্য বিক্রি করে মূলধন গড়েছেন তিনি।
এরপর সময়ের সাথে সাথে গড়ে তোলেন নোমান গ্রুপ, যা বর্তমানে দেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের একটি। সম্প্রতি তিনি কোম্পানির নেতৃত্ব বড় ছেলের হাতে তুলে দিলেও পরামর্শক হিসেবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ব্যবসার শুরুতে তিনি নিজেই সবকিছু করতেন—পণ্য নির্বাচন, নকশা, রঙ নির্বাচন, বিক্রি ইত্যাদি।
বিক্রয়কর্মী থেকে উদ্যোক্তা
১৯৬৮ সালে তৈয়ব আশরাফ টেক্সটাইল মিলসে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই মিলের অধীনে থাকা মরিয়ম টেক্সটাইল, আরটেক্স ফ্যাব্রিকস ও নাজনীন ফ্যাব্রিকসের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে নিজেই পছন্দমতো পণ্য তৈরি করে তা বিক্রি শুরু করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে ফিরে গেলেও যুদ্ধ শেষে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন এবং নতুন করে শুরু করেন ব্যবসা। ব্যাংকঋণের কারণে ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়লে একে একে সেগুলোর যন্ত্রপাতি কিনে নেন। ১৯৭৬ সালে ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আরটেক্স ফ্যাব্রিকসের চারটি মেশিন কেনার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর উদ্যোক্তা জীবন। সে সময় ২২ জন শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু হয়। এখন নোমান গ্রুপে কাজ করছেন ৬৫ হাজারেরও বেশি মানুষ।
নোমান গ্রুপের যাত্রা
নোমান গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে বড় ছেলে এ এস এম রফিকুল ইসলামের নামে। স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও নাতি-নাতনিদের নামেও রয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৬ সালে বড় ছেলে নোমানের জন্ম এবং একই বছর শুরু হয় নুরুল ইসলামের উদ্যোক্তা জীবন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কোনো ব্যাংকঋণ না নিয়ে পুরো ব্যবসা পরিচালনা করেন। এখনো তিনি উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে যুক্ত থাকেন এবং দিনে ১৮-২০ ঘণ্টা সময় দেন।
রপ্তানিতে সাফল্য
২০০০ সালে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফ্যাব্রিকস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয় নোমান গ্রুপের রপ্তানি কার্যক্রম। তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ৪৬টি জাতীয় রপ্তানি পদক, যার মধ্যে ১১টি শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের দুটি স্বর্ণপদক পায়।
২০০০ সালে প্রথমবার ইউরোপে ৬৫ লাখ ডলারের বেডশিট রপ্তানির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি ডলার। বর্তমানে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ১৮-২০ ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে রপ্তানি করে। গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে আইকিয়া, এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, টার্গেটসহ অনেক বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড।
সংকটে হার না মানার গল্প
২০০৯ সালে গাজীপুরে সাতটি কারখানা গড়ে তোলে নোমান গ্রুপ। গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় সাত বছর ধরে কারখানাগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। শুধু সুদের পেছনেই খরচ হয় ২ হাজার কোটি টাকা। অনেকেই তখন এসব কারখানা বিক্রি করতে বললেও তারা ধৈর্য ধরেন। অবশেষে ২০১৫ সালে গ্যাস সংযোগ পেয়ে শুরু হয় উৎপাদন। এর পাশাপাশি ২০১১ সালে তুলার দামের অস্থিরতায় আরও ৮০০ কোটি টাকা লোকসান হয়।
শুধু পরিচিত খাতেই মনোযোগ
নুরুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, যে ব্যবসা ভালোভাবে বোঝা যায় না, তাতে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। তাই বস্ত্র ও পোশাক খাতেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন ব্যবসা। পণ্যের অপচয় এড়াতে চাহিদাভিত্তিক উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তিনি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমান চেয়ারম্যান এ এস এম রফিকুল ইসলাম জানান, ভবিষ্যতে সিনথেটিক ও পলিয়েস্টার নির্ভর ফ্যাব্রিকস তৈরিতে বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি শীর্ষ রপ্তানিকারকের অবস্থান ধরে রাখতে কাজ করছে পুরো টিম।
নুরুল ইসলামের পাঁচ সন্তান। বড় মেয়ে নুর–ই–ইয়াসমিন ফাতেমা উপব্যবস্থাপনা পরিচালক। চার ছেলের মধ্যে বড় এ এস এম রফিকুল ইসলাম চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাকি তিনজন—আবদুল্লাহ জাবের, আবদুল্লাহ মো. জোবায়ের ও আবদুল্লাহ মো. তালহা—উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।