দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ‘পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যাক্ট’ নামে ওই আইনের খসড়া প্রস্তুতের প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
খসড়া তৈরির পর সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আইনটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর ওই আইন মেনেই বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল পরিচালনা করতে হবে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।“যারা এই আইন মানবেন না, তারা রাজনীতি করতে পারবেন না,” বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন।
দেশের আইন অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিজেদের নাম ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হয়। এক্ষেত্রে কারা নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে পারবেন এবং কী ধরনের শর্ত পূরণ করলে নিবন্ধন দেওয়া হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-তে। ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ওই আদেশ সংশোধন করে এ সংক্রান্ত একটি বিধিমালাও তৈরি করা হয়, যা এখনও কার্যকর আছে। কিন্তু তারপরও সরকার কেন ‘পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যাক্ট’ করতে চাচ্ছে? এই আইনে কী ধরনের বিষয় অন্তর্ভু্ক্ত হতে পারে?
‘পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যাক্ট’ আসলে কী?
‘পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যাক্ট’ হচ্ছে এমন একটি আইন, যার মাধ্যমে একটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রাপ্তি, পরিচালনা ও আয়-ব্যয়ের হিসাবসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়। এক্ষেত্রে বেশকিছু নিয়ম-নীতি বেঁধে দেওয়া হয়, যা দলগুলো মেনে চলে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা, এমনকি নিবন্ধন বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুযোগও থাকে। এ ধরনের আইন করার ক্ষেত্রে সাধারণত একটি কমিটি গঠন করা হয়, যারা সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আইনের একটি খসড়া তৈরি করেন।
এরপর রাজনৈতিক দলগুলোসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। কমিটির সুপারিশক্রমে পরবর্তীতে সেটিকে আইনে পরিণত করা হয়। যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের আইন রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাজ্যে আইনটি ‘রাজনৈতিক দল, নির্বাচন এবং গণভোট আইন ২০০০’ নাম পরিচিত। সেখানে নিবন্ধন নেওয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিচালনা ও তহবিল সংগ্রহের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ্বতা নিশ্চিত করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিধি অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়মিতভাবে দেশটির নির্বাচন কমিশনের কাছে আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হয়। যুক্তরাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী, দলগুলো বেনামি এবং বিদেশি কোনো দাতার কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারে না।
এছাড়া নির্বাচনি ক্যাম্পেইনসহ যেকোনও প্রচারাভিযান চালানোর ক্ষেত্রেও ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলো ওই সীমার উপরে খরচ করতে পারে না।
আইনে কী আছে?
দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে পূরণীয় শর্তের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৮ সালের ‘রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বিধিমালা’য়। নিয়ম অনুযায়ী, নিবন্ধন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। এক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যেকোনো একটি নির্বাচনে দলটিকে অন্তত একটি আসন, অথবা পাঁচ শতাংশ ভোট পাওয়ার রেকর্ড কিংবা কমপক্ষে ২১টি জেলায় বা দু’শ উপজেলায় দলের কমিটি থাকা’- এই তিনটি শর্তের যেকোনো একটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করলেই একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারে।
আবেদনের সময় ফি হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দিতে হয়। সেই সঙ্গে, দলের গঠনতন্ত্র, বিধিমালা, নির্বাচনি ইশতেহার, লোগা ও দলীয় পতাকার ছবি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকাও জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়া দলটির তহবিলের উৎস এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণও নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দিতে হয়।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নিবন্ধন পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলটি বিদেশি কোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো দাতার কাছ থেকে উপহার, দান বা অনুদান নিতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে এমন আদর্শের কোনো দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারে না।
নতুন আইন নিয়ে কী জানা যাচ্ছে?
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪টি। এর বাইরে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কমপক্ষে ৮০টি রাজনৈতিক দল নতুন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। যদিও সেগুলোর বেশিরভাগই শেষমেশ নিবন্ধন পায়নি। এতসব রাজনৈতিক দলের গঠন ও পরিচালনাকে একটি সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘পলিটিক্যাল পার্টিস অ্যাক্ট’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমি অলরেডি কয়েকজনকে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) করেছি যে, একটা অ্যাক্ট (আইন) তৈরি করে ড্রাফটটা (খসড়াটা) আমার কাছে দেন। এটা নিয়ে আমরা আইনসংক্রান্ত সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করবো।”
এমন একটি সময় নতুন এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলো, যার আগে প্রায় ‘একতরফা নির্বাচনে’র মাধ্যমে টানা দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতা ছিল আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ এই সময়ে নাগরিকদের বেশিরভাগই ভোট দিতে পারেননি। ওই সময়ে বাক-স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রেও নানান বাধা ও দমন-পীড়ন দেখা গেছে। রয়েছে গুম, অপহরণ ও বিচারবর্হিভূত হত্যার বেশ কিছু অভিযোগ। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারীদের উপরে চালানো হয়েছে গুলি, যাতে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় চাঁদাবাজির যে অভিযোগ ছিল, তাদের পতনের পরও অনেক জায়গায় সেই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদাবাজির এসব অর্থের একটি অংশ রাজনৈতিক দলগুলোর তহবিলে জমা হয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন,“বাচ্চা, বাচ্চা ছেলে-পেলেরা একটা উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিলো। আপনাদের লজ্জা করে না। আপনারা তাদের রক্তের ওপর দিয়ে পলিটিক্স করবেন, আর চাঁদাবাজি করবেন।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে, আইন করে দলগুলোকে এমনভাবে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হবে যে, সেগুলো যেন ভবিষ্যতে ‘স্বৈরাচার’ হয়ে উঠতে না পারে।
“পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্টের মধ্যে যদি থাকেন, পলিটিক্স করতে পারবেন, নাহলে পারবেন না। আপনারা ডিক্টেটোরিয়াল ম্যানার (স্বৈরাচারী আচরণ) করে যাবেন, এটা হবে না,” বলেন সাখাওয়াত।
নতুন আইন করার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান যে কঠোর, সে বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন উপদেষ্টা। বলেন,“রাজনীতি করতে হলে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট অনুযায়ী করতে হবে। তাতে কার অসুবিধা হলো, না হলো– সেটা দেখার বিষয় নয়। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত আছি, আমি এটা করে ছাড়বো।”
নতুন আইনের মাধ্যমে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা নির্বাচন থেকে শুরু করে তহবিল গঠন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে বলে জানা যাচ্ছে। একইসঙ্গে দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা হবে। আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
এই উদ্যোগের বিষয়ে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে আইন তৈরির পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, “উদ্যোগটি ভালো। এতে দলগুলোর স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতার চর্চা বাড়বে বলে আশা করি।”
এর আগে, ১৯৬২ সালেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারও একই রকম একটি আইন প্রণোয়ন করেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর যা বাদ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন,“তখন যে সামরিক সরকার এটি করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল দলগুলোকে দমন করা। কিন্তু এবারের উদ্দেশ্য তা নয়, বরং দলগুলোর মধ্যে স্বচ্ছ্বতা নিশ্চিত করা।” তিনি বলেন,“কাজেই আইন করে সেটির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে ভালো ফল আসবে বলেই আশা করি।”
আইনটির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়েছে জানানো হলেও কবে নাগাদ সেটি চূড়ান্ত হতে পারে, সে ব্যাপারে এখনও সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি সরকার। -বিবিসি।