সাদা ব্যান্ডেজের ওপর লেখা, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ এমন একটি ছবি হাতে নিয়ে বুক চাপড়ে বিলাপ করছিলেন নিহত ফয়সালের বৃদ্ধা মা হাজেরা বেগম। তার আর্তচিৎকারে চারপাশ ভারী হয়ে উঠছিল। পাশে বসে কাঁদছিলেন ফয়সালের বাবাসহ তার ছয় বোন ও স্বজনরা। কাঁদছিলেন প্রতিবেশীরাও।
ফয়সালের মা হাজেরা বেগম কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমার ছেলের জীবনডারে কেউ ভিক্ষা দাও, আহারে আমার নিমাইরে এমনভাবে গুলি করছে যে মাথার মগজও উড়ে গেছে। কোন পাষ- আমার ছেলেরে এমনে গুলি করল, তার কি একটু হাত কাঁপল না? মারছে তো মারছে, ছেলের লাশটাও পাইলাম না!’ তিনি আরও বলেন, ‘পোলারে কত জায়গায় খুঁজছি, কেউ বলতে পারেনি কই আছে, থানায় গেছি, এই হাসপাতালে, ওই হাসপাতালে ঘুরছি, কোথাও পাইনি। ১৩ দিন পর জানছি, আমার ছেলেরে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করছে।
আমার মানিক চানরে কই দাফন করছে তাও কেউ জানে না। মারছে তো মারছে, ছেলের লাশটাও পাইলাম না। কবরে দাঁড়াইয়া যে ফয়সাল বইল্ল্যা ডাক দেমু তাও পারমু না। আহারে ফয়সালরে তুই গিয়া শুইয়্যা আছত, আমার বুকে আয় বাবা।’ সম্প্রতি ফয়সালের বাড়িতে গিয়ে সাংবাদিকরা দেখতে পান এমন আর্তনাদের চিত্র। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফয়সাল সরকার। ঘটনাটি ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায়। পরে ২২ জুলাই থেকে ২৫ জুলাইয়ের কোনো এক সময় বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ফয়সালকে ঢাকায় গণকবর দেওয়া হয়। ১ আগস্ট পরিবারের লোকজন জানতে পারেন ফয়সালকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। নিহত ফয়সাল সরকার কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের সরকারবাড়ির মো. সফিকুল ইসলাম সরকারের ছেলে। সে চলতি বছরে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন।
এরই মধ্যে আট বিষয়ে পরীক্ষা শেষ করেন। পাশাপাশি সংসারের অভাব ঘোচাতে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসে সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা-মা, ভাইসহ পরিবার নিয়ে থাকতেন আবদুল্লাহপুর এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। ফয়সালের ছোট ভাই ফাহাদ সরকার বলেন, ‘১৯ জুলাই বিকালে আবদুল্লাহপুরের শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে যাবেন বলে বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যার পর ভাইয়ের নম্বরের ফোন করলে নম্বর বন্ধ পাই। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি শুরু করি। বাইরে তখনো গোলাগুলি চলছিল। কোথাও খোঁজ না পেয়ে ২৮ জুলাই দক্ষিণখান থানায় জিডি করি। গত ১২ দিন ঢাকার এই হাসপাতালে ওই হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করেছি, কোথাও হদিস পাইনি। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকালে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে খোঁজ নিলে তারা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা লাশগুলোর ছবি দেখালে সেখানে ফয়সাল ভাইয়ের লাশের ছবি দেখতে পাই। কোথায় দাফন করা হয়েছে জানতে চাইলে তারা জানান, ১৫-২০টি লাশ একবারে গণকবর দেওয়া হয়েছে, কাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে তারা তা জানেন না।’
ফয়সালের বড় বোন রোজিনা আক্তার ও নুরুননাহার আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমাদের ছয় বোনের পর এই ভাই। আপনারা আমার ভাইকে এনে দেন। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। আমাদের সংসার এখন কে চালাবে? আমাদের কি হবে? এই ভাই রোজগার করে বোনদের বিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা কানে শোনে না।’ ফয়সালের বাবা বৃদ্ধ মো. সফিকুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমার ছয় মেয়ের পর ফয়সাল হইছে। এই ফয়সাল লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলী বাসে পার্টটাইম সুপাইভাইজারের কাজ করে সংসার চালাতো। এখন আমার পুরো সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। কারা আমার ছেলেকে হত্যা করল? কী দোষ ছিল আমার ছেলের? সে তো রাজনীতি করত না, পেটের দায়ে বাসে কাজ করত। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো? এই বিচার আমি কার কাছে দেব?’ দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিগার সুলতানা বলেন, ১৩ দিন পর ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি জানতে পেরেছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। এর আগেও ঢাকায় নিহত কয়েকজনের বাড়িতে আমি গিয়েছি, সহযোগিতা করেছি। ফয়সালের পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে। সরকারিভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।