বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে অনেক তারকাই সংহতি জানিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একজন তরুণ জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তাসরিফ খান।
আন্দোলন চলাকালে ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ শীর্ষক গানের সঙ্গে প্রতিবাদের মিছিলে যোগ দেন তিনি।
এ কারণে গেল জুলাইয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাসরিফকে। তার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল রড দিয়ে। তারই বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন এই শিল্পী।
বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) রাতে তিনি ফেসবুকে ‘কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক’ শিরোনাম দিয়ে বিষয়টি তুলে ধরেন তাসরিফ। তিনি লেখেন, ২৩ জুলাই রাত রাত ১টার কথা বলছি। একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললেন, ‘তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে। ’
৫ জুলাই থেকে ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট করা, কবিতা লিখতে থাকা এবং ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গানটা ফেসবুকে চলতে থাকায় সরকারি গুণ্ডা বাহিনীর থ্রেটে আমি তখন বাসার বাইরে অবস্থান করছিলাম। ওই সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় বিশ্বাস করে আমি তখন বাসার সামনে আসি উনার সঙ্গে দেখা করতে। গাড়ি থেকে ৬-৭ জনের মতো নেমে আসে।
ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আমাকে একটু সাইডে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলেন, ‘সাথে যারা আছে তারা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগ সংস্থার বাহিনীর কয়েকজনও আছে এখানে। ’ আমি তখন উনার কাছে জানতে চাই যে, উনারা কেন এসেছেন, কী চাচ্ছেন মূলত! উনি তখন বুঝায়ে বলেন, ‘সরকারি একটা কাজ আছে, এই সরকার আরো ৭-৮ বছর ক্ষমতায় থাকব। আমরা ঠিকমতো বাঁচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হইবো, এর বাইরে কোনো রাস্তা নাই। ’
এই কথা বলে উনি (ইনফ্লুয়েন্সার) আবার আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। সেই ৬-৭ জনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলে, ‘তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিতেছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এই ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবেন এবং তারপর তুমি আপলোড করবা। ’
সেই ইনফ্লুয়েন্সার তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাকে বলেন, ‘দেখ তাসরিফ, পিএমের চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ, ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যত দিন আছে সুবিধা পাবি। ’ কথা শেষ করার আগেই উনি পকেট থেকে এক লাখ টাকার তিনটা বান্ডেল, মোট তিন লাখ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইটা সামান্য ছোট একটা গিফট! টাকা যত চাস, তত দেওয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর। ’
তখনই তার ফোনে একটা ফোন আসে বলে জানান তাসরিফ। তিনি লেখেন, ঠিক এই সময় আমার ফোনে আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নম্বর থেকে একটা কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তাসরিফ! পাঁচ-ছয়জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলায়ে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে!’ শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা একরকম কাঁপতে থাকে। আমি বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর খাওয়াটা কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখানো? নাকি কেবলমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? শান্তর লাইন কেটে যায়।
তাসরিফ যোগ করেন, আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেওয়া তাদেরকে বলি, ‘ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে প্রচুর মারছে!’ ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আরেহ! দেশের যে অবস্থা, এটা এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে। ’
এই গায়ক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরো লেখেন, আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি ওদেরকে টাকা ফিরিয়ে দিই অথবা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তারা আমাকে চাইলেই গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারে। আমি তাই মাথা ঠাণ্ডা করে ওদেরকে বলি ঠিক আছে আমি দেখতেছি কী করতে পারি, কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। ওরা আমাকে তখনো একরকম থ্রেট দিয়ে বলে, ‘ভাই জানাচ্ছির সুযোগ নাই! সিচুয়েশন তো বুঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে। ’ সাথে ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলে, ‘তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে সো বুইঝা শুইনা সুন্দর কইরা করিস। ’
ওদের সাথে কথা শেষ করে আমি বাসায় ফেরত যাই। বাসায় সবাইকে সব সিচুয়েশন জানিয়ে আমি আমার ম্যানেজার আয়মান সাবিতকে ফোন দিয়ে বলি, ‘আয়মান, আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, এই এই ঘটনা ঘটছে। আমি তোকে নম্বর দিচ্ছি, তুই ওই এজেন্সিকে আমার বাসা থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে ওদেরকে দিয়ে দিবি কালকেই। আমি আপাতত বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, কারণ আমি বাসায় থাকলে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। ’
ওই সময় আমার মনের অবস্থা আমি জানি। আমার বাসার অবস্থা ডায়াবেটিসের রোগী আমার আম্মুর অবস্থা, আব্বুর টেনশন, গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা এবং দেশের সাথে বেইমানি করতে ওরা আমাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে। সব কিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাথে বারবার আমার কানে বাজছে শান্তর ওই কান্না ভরা আর্তনাদ।
কষ্টের ব্যাপার কী জানেন? এই ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে শান্ত আমাকে ফোন দিয়ে বলছিল, ‘খান, আমার বাসায় আম্মা নাই। এদিকে কারফিউ চলছে, দুপুরের খাওয়া হয় নাই, একটা দোকানও খোলা নাই আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগছে, কী করব?’। আমি শান্তকে বলছিলাম, ‘এক বড় ভাই ফোন দিছে, আমার বাসার সামনে যাওয়া লাগতেছে, তো তুমি আমার বাসায় চইলা আসো, দুই ভাই একসাথে খাব’। ছেলেটা চাইছিল আমার বাসায় এসে ভাত খাইতে অথচ তাকে রাস্তায় বেধড়কভাবে মাইর খাইতে হইল। মার খাওয়ার পরে ফোনকলে ও আমাকে এটাও বলছিল যে, ‘খান! সবাই আমারে একসাথে রোল দিয়ে মারতেছিল আর একজন বন্দুক তাক করে চিল্লায়ে বলছিল, চুপচাপ মাইর খা অমুকের পোলা নাইলে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, লাশ খুঁজে পাইব না তোর পরিবার!’
শান্ত এই কথাটা বলতে বলতে কাঁদতেছিল যে, ‘আমাকে ছাত্র বইলা বইলা ওরা মারছে আর বারবার বলতেছিল যে এই অমুকের পোলা ছাত্র! ওরে মার!’ ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই।
আন্দোলনের সঙ্গে শুরু থেকেই ছিলেন জানিয়ে তাসরিফ বলেন, আমি জানি কয়েকটা পোস্ট, কবিতা লেখা আর ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’-এর মতো কিছু গান করা ছাড়া দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নাই। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মতো পথে গিয়ে বুক পেতে দিতে পারি নাই। হয়তোবা এতটুকু সাহস আমার তখন হয় নাই। তবে, আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হয় নাই আর দেশের সাথে বেইমানি করি নাই।
এই পোস্ট, পোস্টে শান্তর ছবিগুলা এবং ওদের নির্মমতার কথাগুলা আমি লিখে পোস্ট করছি এই কারণে, যেন ভবিষ্যতে কখনো এই স্বৈরাচারের প্রতি আমার ঘৃণা এতটুকু পরিমাণও কমে না যায়।