স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর পাঁচ উপজেলা। সম্পদ নয়, প্রাণ বাঁচানোই মুখ্য হয়ে উঠেছে মানুষের। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার। নেই বিদ্যুৎ সংযোগও।
ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপ ও অবিরাম বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যায় দুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ারসার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দিয়েছেন। তবে দুর্গত এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ও পানির প্রবল স্রোত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম। অনেকে ত্রাণ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আগে উদ্ধার জরুরি বলে আকুতি জানাচ্ছেন লোকজন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধারের দাবি জানাচ্ছেন।
সাংবাদিক আহনাফ তাহমিদ ফাইয়াজ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ফেনীর মোটবীতে খুব দ্রুত একটা বোট প্রয়োজন। দুইতলা ভবনের ছাদে ১৬ জন মানুষ অবস্থান করতেছে। সেই ভোর থেকে তারা বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বাচ্চাও রয়েছে সেখানে। কেও সাহায্য করতে পারলে আমাকে নক দিবেন। বিস্তারিত ঠিকানাটা দিব। প্লিজ!’
পরে মন্তব্যের ঘরে আহনাফ লিখেন, ‘বেশ কয়েকটা উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে এমন টিমের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা পারতেছে না আর উপজেলাগুলোতে প্রবেশ করতে। ফেনী সদরের বাইরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো তাদের জন্য বর্তমানে অনেক কষ্টসাধ্য বলে জানায় তারা। তাও যদি কোনো সম্ভাবনা থাকে, কোনো বোটের খোঁজ পাওয়া যায় জানানোর জন্য অনুরোধ রইলো।’
আরেক সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। পানি ক্রমশ ফুঁসছে। বাড়িতে পানির ধাক্কায় সাইডের মাটি সরে রান্নাঘর কাত হয়ে গেছে। যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে যেতে পারে।
যেকোনো সময় আমার ঘরে পানি ঢুকবে। বিদ্যুৎ নেই। ঘরে মা একলা। তাকে যে আত্মীয় কারও বাড়িতে পাঠাব, সেটারও সুযোগ পাচ্ছি না। রাস্তায় হাঁটু পানি। দিশা খুঁজে পাবে না, তাই ভ্যানও চলছে না।
আবার অনেক আত্মীয়ের ঘরে পানি উঠেছে। খাটের নিচে পানি। সবাই খাটের ওপরে বসে আছে। বেরোনোর রাস্তা নেই।
ফেনীতে এটা স্মরণকালের সর্বোচ্চ বন্যা। বিশেষ করে আমার থানায় বিগত সময়গুলোতে বন্যা একদমই না হওয়ায় মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
আল্লাহ, তুমিই একমাত্র সহায়…’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার কার্যক্রমের চিত্র ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তুলে ধরে জানিয়েছে, ‘ফেনী জেলার পরশুরাম ও ফুলগাজীতে বন্যার্তদের উদ্ধারে মোতায়েন হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে স্পিড বোট ও হেলিকপ্টার।’
বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের উদ্ধার কার্যক্রমের চিত্র ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তুলে ধরে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) জানিয়েছে, ‘নৌবাহিনীর আরো দুটো কন্টিনজেন্ট ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে ফেনীতে বন্যা দুর্গত এলাকায় উদ্ধারকার্যে অংশগ্রহণ করেছে। ডুবুরি সামগ্রী, লাইফ-জ্যাকেট, স্পিড বোট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে উদ্ধারকার্যে। জরুরি চিকিৎসা সেবা ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
লোকজন ওই পোস্টে মন্তব্য করে উদ্ধারের আকুতি জানাচ্ছেন। মো. রাসেল লিখেছেন, ‘ফেনী থেকে পুরো দেশের কাছে আবেদন: এই মুহূর্তে খাবার নয়, আগে স্পিড বোট আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাঠান। মানুষ বাঁচান! আমাদের বাঁচান।’
ঢাকা কলেজ ফেনী ছাত্র সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক পারভেজ ওয়াহিদ লিখেছেন,
‘প্লীজ উদ্ধার করুন আগে, খাদ্য এখন লাগবে না।’
লোকজনকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন সাবিত লিখেছেন, ‘ফুলগাজীর ৭ নং ওয়ার্ড জয়পুর এখন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ! তেমন কোন উদ্ধার কার্যক্রম নেই। কি হচ্ছে, মানুষগুলো কেমন আছেন কেউ বলতে পারছেন না। স্পিড বোট প্রয়োজন। মানুষগুলোকে বাঁচান।’
নুসরাত জাহান লিখেছেন, ‘খাবারের চেয়ে এখন জীবিত উদ্ধার জরুরি। প্লিজ ফুলগাজী উপজেলার জি.এম.হাট ইউনিয়নের পূর্ব ও পশ্চিম বশিকপুর এলাকায় অনেকে আটকে আছে। ওখানে কেউ যান। পানি দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে।’
পরশুরামে উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করার আকুতি জানিয়ে মোশারফ হোসেন নাহিদ লিখেছেন, ‘সবাই শুধু ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া নিয়ে আওয়াজ তুলতেছেন, ভাই অইদিকে মোটামুটি উদ্ধার কাজ চলছে। এখন পরশুরামের বক্সমাহমুদ ইউনিয়ন নিয়ে আওয়াজ তুলেন। এইদিকে টেটেশ্বরসহ বাঘমারা, চারিগ্রাম, কহুয়া তালবাড়ীয়ার মানুষ পানিবন্দী, শুকনো খাওয়ার নাই, বিশুদ্ধ পানি নাই, এটা নিয়ে কথা বলেন প্লিস। স্বেচ্ছাসেবীদের সেনাবাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, এলাকায় কারো সাথে যোগাযোগ নাই। কি হইতেছে জানিনা, সবাই এটা নিয়ে একটু কথা বলেন। আর কেউ বক্সমাহমুদের খবর জানলে জানাবেন।’
সাজ্জাদুর রহমান সাকিব লিখেছেন, ‘ফেনীর পরশুরাম এখন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ! তেমন কোন উদ্ধার কার্যক্রম নেই। দুইদিন ধরে ওখানকার খবর কেউ দিতে পারতেছে না, কি হচ্ছে, মানুষগুলো কেমন আছেন কেউ বলতে পারছেন না। স্পিড বোট বা নৌকার চেয়েও হেলিকপ্টার রেসকিউ প্রয়োজন। প্লিজ আপনারা পরশুরামের মানুষদের বাঁচান।’
মোঃ আবদুল হাই ইমরুল লিখেছেন, ‘ফেনী পরশুরামের ৩ নং চিথলীয়া ইউনিয়নের দূর্গাপুর ও রামপুর এবং রতনপুরসহ আরো এলাকার প্রায় ৩০০ এর বেশি মানুষ স্কুলের ছাদে আটকে আছি গত ২ দিন। যদি সম্ভব হয় আমাদের উদ্ধার করেন। খাবার পানি ঔষধের দরকার অনেক বেশি।’
ফেনীর আরেক বাসিন্দা শাকিল হোসেন লিখেছেন, ‘আমার মেজো জেঠা আর জেঠীমা দুপুর থেকে বাড়ির ছাঁদে আঁটকায় আছে। আমার ফ্রেন্ড লিস্টের কেউ রেসকিউ টিমের সাথে যুক্ত থাকলে উনাদেরকে একটু উদ্ধার করেন। লোকেশন: ভূঁইয়া ম্যানশন, কাছারি বাজার ব্রীজের পর রাস্তা পূর্ব পাশের বাড়ির ২য় গেট, কাছারি বাজার, পাঠান নগর, ছাগলনাইয়া, ফেনী।’
আরিফুল আরিফ লিখেছেন, ‘ফেনীতে বর্তমানে যারা উদ্ধার কাজে আছেন ফাজিলপুর, ছনুয়া, আব্দুল মুন্সী ঘাট এই এলাকাগুলোতে রেসকিউ টিম, বোট পাঠানোর ব্যবস্থা করুন যতো দ্রুত সম্ভব। ওখানের এক তলা ঘর ডুবে পুরো এলাকার মানুষজন দুই তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে অবস্থানে আছে। 01647541228 পলক, 01764709204 মাসুদ।’
মামুনুল হক হৃদয় লিখেছেন, ‘ফেনী সদরের ফাজিলপুর,ভুইয়ারহাট, মোটবী এলাকায় এখনো অনেক মানুষ আটকে আছে। সদর উপজেলার দিকে নজর দেয়ার আহবান করছি।’
এর আগে বুধবার রাতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের ফেসবুক পেজে জানায়, ‘ফেনীতে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় মাননীয় নৌবাহিনী প্রধানের দিকনির্দেশনায় কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিশেষায়িত কন্টিনজেন্ট। ভারী বর্ষণে পানিবন্দি অসহায় মানুষদের বোটের মাধ্যমে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ইতোমধ্যে কাজ করে চলছে নৌবাহিনী। পাশাপাশি, প্লাবিত এলাকাসমূহে জানমালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন রয়েছে নৌবাহিনীর ডুবুরি দলও। এছাড়াও নৌবাহিনী চিকিৎসক দল পানিবন্দি এলাকাগুলোতে জরুরি চিকিৎসা সহায়তায় বিশেষ মেডিকেল টিম, জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, স্যালাইনসহ ও বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। উল্লেখ্য, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নৌবাহিনীর এই সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
সময়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন দুর্গত অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। সেনা ও কোস্টগার্ডের ২৪টি বোট উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। বন্যায় জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ।
পরশুরামের বীর চন্দ্রনগর গ্রামের আবদুল কাইয়ুম জানান, প্রবল স্রোতে এখন সম্পদ নয়, মানুষের জান বাঁচানোই দায় হয়েছে। বন্যার্তরা প্রাণ বাঁচানোর করুন আকুতি জানাচ্ছে।
পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ফেনী শহরের একটি হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তনাদ আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল হিসেবে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।
পরশুরামের শালধর গ্রামের মো. রহিম জানান, বেশিরভাগ এলাকার একচালা ও একতলা পাকাঘর ডুবে গেছে। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
আনন্দপুর ইউনিয়নের মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় প্রতিবছর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বন্যা হলেও ১৯৮৮ সালের পর এই ধরনের ভয়াবহ বন্যা আর হয়নি। তিন উপজেলায় প্রায় প্রতিটি বাড়ি ও বসতঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে।
দাগনভূঞা উপজেলার ওমরাবাদ গ্রামের আকবর হোসেন বলেন, পরিবার-পরিজন ও কেবল প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। পানিতে ঘরবাড়িসহ চারপাশ ডুবে গেছে।
ফেনী শহরের ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন লিটন বলেন, শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত। দোকানপাটে পানি প্রবেশ করে মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. আবুল কাশেম বলেন, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে হু-হু করে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঠিকভাবে উদ্ধার কাজও করা যাচ্ছে না। এখনো বৃষ্টির সঙ্গে পানি বাড়ছে।
জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যা পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। এখনো পাঁচ উপজেলার তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কতজনকে উদ্ধার করা হয়েছে বা কোন এলাকায় কেমন আক্রান্ত হচ্ছে তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। পানির তীব্র স্রোতের কারণে কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না।