আর্থিক কারণে অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াশোনার সুযোগ হয়নি অনিক হাওলাদারের (২০)। অন্য ভাইদের সঙ্গে তাঁকে কাজে নামতে হয়। অনিকের এমন বন্ধু আছেন, যাঁরা পড়াশোনা করছেন। তাঁরা গত জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলনে তাঁকে অংশ নিতে বলেন।
বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে গত ১৮ জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন অনিক। সেদিনই তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হন। অনিক বলেন, তাঁর চোখ-মুখ-মাথায় গুলি লাগে। দুটি চোখই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি একটি চোখে আবছা দেখতে পান। অপর চোখটি আর ভালো হবে কি না, জানেন না।
তা ছাড়া তাঁর মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়। এই যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়। অনিকের বাড়ি মাদারীপুর সদরে। বাবা নুরুল ইসলাম। ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর চার ছেলে ও তিন মেয়ে। চার ছেলের মধ্যে অনিক তৃতীয়। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে থাকেন নুরুল। তিনি পেশায় রিকশাচালক। তবে বয়সের কারণে এখন আগের মতো রিকশা চালাতে পারেন না। ছেলেরাই সংসার চালান। তবে ছেলেদের সবার নিয়মিত আয় নেই। তাঁরা রাজমিস্ত্রি, মালামাল সরবরাহে সহায়তাকারীর কাজ করেন।
কয়েক বছর আগে অনিক একটি আইসক্রিম কোম্পানিতে যুক্ত হন। তিনি দোকানে দোকানে আইসক্রিম সরবরাহের কাজ করতেন। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ জুলাই মাদারীপুরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয়।
বিক্ষোভে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা চালান। একই দিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয়। এসব বিক্ষোভ দমনের নানা ভিডিও অনিকের চোখে পড়ে। অনিক বলেন, তাঁর পড়ুয়া বন্ধুরা তাঁকে ফোন করে আন্দোলনে আসতে বলেন। তিনি বন্ধুদের ডাকে ‘না’ করতে পারেননি।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে অনিক বলেন, গত ১৮ জুলাই সকাল ১০টা নাগাদ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি মাদারীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইউআই স্কুল এলাকায় জড়ো হন। সেখান থেকে যান ডিসি ব্রিজ এলাকায়। বিক্ষোভ দমাতে সেখানে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
একপর্যায়ে বিক্ষোভ দমনে পুলিশও যুক্ত হয়। তিন পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়ে। শিক্ষার্থীরা ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনিক দৌড়ে মাদারীপুর পাসপোর্ট অফিসের সামনে চলে যান। তিনি আশপাশের ভবনের ছাদে পুলিশ দেখতে পান।
হঠাৎ করে তাঁর সামনে কয়েকজন পুলিশ চলে আসে। অনিক বলেন, তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাছ থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। অনিকের ভাষায়, ‘প্রথমে গুলি আমার চোখে লাগে। এরপর আর কিছু দেখতে পাই নাই। কিন্তু মাথা-চোখে-মুখে যে আরও গুলি লাগতেছে, তা আমি বুঝতে পারি। দৌড়াতে পারি নাই।
হাঁটতে হাঁটতে আগাইলে (এগোলে) কিছুর সঙ্গে বাড়ি খেয়ে পড়ে যাই। পরে ছাত্ররা আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ হাসপাতালে গিয়েও ঝামেলায় পড়েন বলে জানান অনিক। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে দেখে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে যেতে দিচ্ছিল না।
পরে তাঁর তথ্য নিয়ে, ছবি তুলে, মামলা দিয়ে তাঁকে যেতে দেওয়া হয়। অনিক বলেন, ‘মাদারীপুর সদরের পুরান বাজারে কী না কী ঝামেলাই হইছে। সেই ঘটনায় আমার নামে মামলা দেয়। কিন্তু আমি তো ওদিকে যাই–ই নাই।’ জুলাইয়ের উত্তাল সময়ে ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।
অনিককে ১৯ জুলাই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকেও তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলা হয়। পরদিন রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হন অনিক। তিনি বলেন, এখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে জানান, তাঁর দুটি চোখই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এখানে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। পরবর্তী সময়ে রাজধানীর বাংলাদেশ আই হসপিটালে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন অনিক। তিনি বলেন, এখানে তাঁর ডান চোখে অস্ত্রোপচার হয়। তিনি এখন এই চোখের এক পাশ দিয়ে আবছা দেখতে পান। কিন্তু সোজাসুজি কিছু দেখতে পান না। আর তাঁর বাঁ চোখ ভালো হবে কি না, তা তিনি জানেন না।
বাংলাদেশ আই হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শল্যবিদ নিয়াজ আবদুর রহমান অনিকের চিকিৎসায় যুক্ত ছিলেন। এখানে বিনা মূল্যে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানান নিয়াজ আবদুর রহমান। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন,
অনিকের দুই চোখে গুলি একদম সামনে থেকে লেগে কর্নিয়া ভেদ করে অরবিটে (অক্ষিকোট) ঢুকে গেছে। তাঁর দুই চোখই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁর ডান চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে। সেখানে অনেক রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। চোখটির মাঝখানে অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই এই চোখে তাঁর সোজা তাকিয়ে দেখার সম্ভাবনা কম।
পাশ দিয়ে আবছা হয়তো দেখবেন। বাঁ চোখের অবস্থা অনেক খারাপ। এই চোখে কর্নিয়া লাগবে। সে ক্ষেত্রে কাউকে চক্ষুদান করতে হবে। এ ছাড়া তাঁর মাথার খুলিতে গুলি আছে। এর জন্য তাঁর নিউরো চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। অনিক হাওলাদারের মাথাসহ পুরো মুখমণ্ডলের এক্স-রের ছবিছবি:
পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে গত ১৭ আগস্ট চিকিৎসক দেখিয়েছিলেন অনিক। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি তাঁর মাথাসহ পুরো মুখমণ্ডলের এক্স-রে করেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলোজি বিভাগের এক চিকিৎসককে এই এক্স-রের ছবি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দেখানো হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই চিকিৎসক বলেন, এক্স-রের ছবি দেখে তাঁর মনে হচ্ছে, মাথার খুলিতে অসংখ্য আঘাত (গুলির) আছে। কোথাও কোথাও ধাতব বস্তুও থাকতে পারে।
ঘটনার বিবরণ, রোগীর অবস্থা ও এক্স-রের ছবি দেখিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার কাছে গুলির সম্ভাব্য ধরন সম্পর্কে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শটগানের কার্তুজের (লেড বল) আঘাতে এমনটা হতে পারে। এগুলো কাছে থেকে ছুড়লে ভেতরে ঢুকে যায়। তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া এগুলো বের করা যায় না।
প্রথমে সুদের ওপর ৫০ হাজার টাকা ধার করে ছেলেকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়েছিলেন বলে জানান অনিকের বাবা নুরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক দল ও কিছু বেসরকারি সংগঠন থেকে অনিকের চিকিৎসার জন্য তাঁরা কিছু সহায়তা পেয়েছেন।
তবে ছেলের জন্য দৌড়াদৌড়িসহ নানা খাতে ইতিমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। অনিক বলেন, ‘অনেক কষ্ট হয়। চোখের কী হবে জানি না। ওদিকে মাথাভর্তি গুলি নিয়ে রাতে ঘুমাতে গেলে মাথাব্যথা করে। মাথা ভার হয়ে থাকে। আমার উন্নত চিকিৎসা দরকার।’
Priyo Bangla 24 – Most Popular Bangla News The Fastest Growing Bangla News Portal Titled Priyo Bangla 24 Offers To Know Latest National And Local Stories.