আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের এক মৃত যুবকের শুক্রাণু তার বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিতে দিল্লির একটি হাসপাতালকে নির্দেশ দিয়েছে সেখানকার আদালত। মৃত সন্তানের শুক্রাণু ব্যবহার করে নাতি বা নাতনির জন্ম দেয়াতে চান ওই দম্পতি।
প্রায় চার বছর ধরে দিল্লির হাসপাতালটির সঙ্গে আইনি লড়াইয়ের পর জয় হয়েছে ওই দম্পতির।
মৃত যুবকের মা হসবির কউর বলেছেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য যে ছেলেকে হারিয়েছি। তবে আদালত একটি বহুমূল্য উপহার দিলো। এখন আমরা সন্তানকে ফিরে পেতে পারব।”
মিসেস কউর ও তার স্বামী গুরভিন্দর সিংয়ের মৃত সন্তান প্রীত ইন্দর সিংয়ের যে শুক্রাণু গঙ্গারাম হাসপাতাল সংরক্ষণ করে রেখে দিয়েছিল, তারা সেটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করায় মামলা দায়ের করেছিলেন ওই দম্পতি।
কেন মৃত্যুর আগে শুক্রাণু সংরক্ষণ?
এই দম্পতির ৩০ বছর বয়সী পুত্রের এক ধরনের রক্তের ক্যান্সার ধরা পড়ে ২০২০ সালের জুন মাসে। ‘নন-হজকিংস লিম্ফোমা’ নামের ওই রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করা হয়েছিল গঙ্গারাম হাসপাতালে।
“কেমোথেরাপি শুরু করার আগে হাসপাতাল থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে একবার চিকিৎসা শুরু হলে তার শুক্রাণুর গুণমান খারাপ হয়ে যেতে পারে। সেজন্য শুক্রাণু জমিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছিল,” বলছিলেন গুরুভিন্দর সিং।
অবিবাহিত প্রীত ইন্দর সিং হাসপাতালের পরামর্শ মেনে নেন এবং তার শুক্রাণু সংগ্রহ করে বরফের আকারে জমিয়ে রাখা হয় ২০২০ সালের ২৭শে জুন। সেপ্টেম্বরে মারা যান প্রীত ইন্দর সিং।
কয়েক মাস পরে তার বাবা-মা হাসপাতালের কাছে ফেরত চান পুত্রের শুক্রাণু। কিন্তু হাসপাতাল তাদের সেই আবেদনে সাড়া দেননি। তারপরেই দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানান ওই দম্পতি।
তারা আদালতে বলেছিলেন যে পুত্রের শুক্রাণু ব্যবহার করে যে নবজাতক আসবে, তাকে বড় করে তোলার দায়িত্ব নেবেন ওই দম্পতি। তারা মারা গেলে সেই নাতি বা নাতনির সব দায়িত্ব নেবেন বলে আদালতে লিখিত অঙ্গীকার জমা দেন দম্পতির দুই কন্যা।
সংরক্ষিত শুক্রাণু দিয়ে গর্ভধারণ
বিচারপতি প্রতিভা সিং তার নির্দেশে বলেছেন, “ভারতীয় আইন অনুযায়ী মৃত্যুর পরে সন্তান জন্মের ওপরে কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই”, যদি যার শুক্রাণু, তিনি আগেই নিজের সম্মতি দিয়ে থাকেন।
আদালতে রায়ে আরও বলা হয়েছে যে স্ত্রী বা সন্তান না থাকলে ওই শুক্রাণু পাওয়ার অধিকার রয়েছে মৃত ব্যক্তির বাবা-মায়ের, কারণ হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী তারাই মৃত ব্যক্তির আইনি উত্তরাধিকারী।
ওই দম্পতি বলছেন তারা চেয়েছিলেন যে তাদের সন্তানের উত্তরাধিকার বজায় থাকুক। আদালতের এই নির্দেশে মৃত সন্তানের সঙ্গে একটা সংযোগ তারা রক্ষা করতে পারবেন, পারিবারিক নামটাও বহমান থাকবে।
“নিজের বোনেদের ও খুব ভালোবাসত। বন্ধুরাও ওর খুব কাছের ছিল। আমার ফোনে স্ক্রিনসেভারে ওরই ছবি রয়েছে। আমার দিনটা শুরুই হয় ওর মুখটা দেখে,” বলছিলেন মিসেস কউর।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে তিনি ছেলের কোনও ছবি দিতে চাননি।
তিনি এও জানালেন যে ছেলের ওই শুক্রাণু ‘সারোগেসি’র মাধ্যমে গর্ভধারণ করানোর কথা ভাবছে তাদের পরিবার। ওই দম্পতির এক কন্যা, মৃত প্রীত ইন্দর সিংয়ের এক বোন ‘সারোগেসি’তে রাজি হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন মিসেস কউর।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে সারোগেসি কথাটার সহজ অর্থ করা যেতে পারে অন্য মায়ের গর্ভ ব্যবহার করে সন্তান জন্মদান।
তার কথায়, “আমার বিষয়টা পরিবারের মধ্যেই রাখতে চাই।”
বিরল ঘটনা
ওই দম্পতির আইনজীবী সুরুচি আগরওয়াল বলছিলেন, এই ঘটনা বিরল তবে আগে যে কখনও ঘটেনি, তা নয়।
মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে ২০১৮ সালে এরকমই একটি ঘটনা হয়েছিল বলে তিনি আদালতে জানিয়েছেন। ওই ঘটনায় ৪৮ বছরের এক নারী তার মৃত পুত্রের শুক্রাণু ‘সারোগেসি’র মাধ্যমে ব্যবহার করিয়েছিলেন। তার দুই নাতি-নাতনির জন্ম হয়েছিল। ওই নারীর পুত্র ২৭ বছর বয়সে জার্মানিতে মস্তিষ্কের ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন।
ওই যুবকও অবিবাহিত ছিলেন এবং নিজের মা ও বোনকে অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন যে মৃত্যুর পর যেন তারা শুক্রাণু ব্যবহার করতে পারেন। জার্মানির যে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়েছিল, সেখানকার কর্তৃপক্ষ জমিয়ে রাখা শুক্রাণু তুলে দিয়েছিল পরিবারের হাতে।
মিজ আগরওয়াল ২০১৯ সালের নিউ ইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার কথাও উল্লেখ করেছেন। এক সেনাসদস্য দুর্ঘটনায় মারা যান ২১ বছর বয়সে। বরফ হিসাবে জমিয়ে রাখা শুক্রাণু ব্যবহার করে তার বাবা-মা একটি শিশুর জন্মের ব্যবস্থা করেছিলেন।
যে সব দেশে আইনি স্বীকৃতি আছে
বিচারপতি প্রতিভা সিং তার আদেশে একাধিক এমন ঘটনার উল্লেখ করেছেন যেখানে মৃত্যু-পরবর্তী প্রজননের উদাহরণ রয়েছে। ২০০২ সালে ১৯ বছর বয়সী এক ইসরায়েলি সেনাসদস্যর মৃত্যু হয়েছিল গাজায়। তার বাবা-মা আদালতের আদেশ নিয়ে সারোগেট মায়ের গর্ভে সন্তানের শুক্রাণু প্রতিস্থাপন করিয়ে একটি শিশুর জন্ম ঘটিয়েছিলেন।
বিচারপতি তার আদেশে উল্লেখ করেছেন যে এই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে মতৈক্য নেই এখনও।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চেক প্রজাতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ লিখিত অনুমতির ভিত্তিতে মৃত্যু-পরবর্তী প্রজননের অনুমতি দেয়। অস্ট্রেলিয়াতে একটি বাড়তি শর্ত থাকে, যেখানে মৃত্যুর পরে পরিবারের আবেগ সামলানোর জন্য এক বছর সময় দেওয়া হয় মৃত্যু-পরবর্তী প্রজননের অনুমোদন দেওয়ার আগে।
তবে ইতালি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি ও স্লোভেনিয়াতে এ ধরনের প্রজননের অনুমোদন দেওয়া হয় না। আর ভারতের প্রতিবেশীদের মধ্যে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে এই বিষয়ে কোনও নীতিমালা নেই।
যেসব দেশে মৃত্যু-পরবর্তী প্রজননের আইনি স্বীকৃতি আছে, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর কাছ থেকেই বরফাকারে জমিয়ে রাখা ডিম্ব বা শুক্রাণু ব্যবহার করে গর্ভধারণের আবেদন আসে।
ইসরায়েলে অবশ্য মৃত ব্যক্তির বাবা-মায়েরা তাদের পুত্র সন্তানের শুক্রাণু ব্যবহার করে প্রজনন ঘটাতে চাইছেন, এরকম ঘটনা বাড়ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে ইউক্রেনের সেনা সদস্যদের বিনা খরচে শুক্রাণু সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
ভারতে অবশ্য এভাবে প্রজননের ঘটনা বিরল।
হাসপাতালের কেন আপত্তি?
গঙ্গারাম হাসপাতাল আদালতে যুক্তি দিয়েছিল তারা কোনও মৃত ব্যক্তির শুধুমাত্র স্ত্রী বা স্বামীর কাছেই সংরক্ষিত শুক্রাণু হস্তান্তর করতে পারে। অবিবাহিত কোনও মৃত পুরুষের সংরক্ষিত শুক্রাণু তার বাবা মা অথবা আইনসম্মত উত্তরাধিকারীকে দেওয়ার ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই বলেও তারা জানিয়েছিল।
ভারত সরকারও ওই দম্পতির আবেদনের বিরোধিতা করেছিল। সরকার বলেছিল ‘সারোগেসি’ সংক্রান্ত যে আইন আছে ভারতে, তা শুধুমাত্র বন্ধ্যা দম্পতি বা নারীকে প্রজননে সহায়তা করার জন্য। এই আইন কাউকে নাতি-নাতনির জন্ম দেওয়ার জন্য নয়।
সরকার এই যুক্তিও দিয়েছিল যে সারোগেসি সংক্রান্ত যে আইন ২০২১ সালে হয়েছে, সেখানে ‘সিঙ্গেল’ নারী অথবা পুরুষ সারোগেসির মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেওয়া নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে প্রীত ইন্দর সিং অবিবাহিত ছিলেন এবং তিনি বরফাকারে জমিয়ে রাখা শুক্রাণু ব্যবহার করার কোনও লিখিত অথবা মৌখিক অনুমতিও দিয়ে যাননি। তাই তার বাবা-মা উত্তরাধিকার সূত্রে ওই শুক্রাণু পেতে পারেন না।
‘আশার আলো’
ওই দম্পতির আইনজীবী মিজ. আগরওয়াল আদালতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে শুক্রাণু সংরক্ষণের জন্য যে ফর্ম পূরণ করেছিলেন মি. সিং, সেখানে স্পষ্ট করে লেখা ছিল যে আইভিএফ পদ্ধতিতে কাজে লাগানোর জন্যই শুক্রাণু সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
তিনি এটাও জানান যে বাবা এবং মা দুজনেরই মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল ওই ফর্মে, তার অর্থই হলো যে তিনি বাবা-মায়ের কাছে সংরক্ষিত শুক্রাণু তুলে দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। মিজ আগরওয়াল বলেন যে তার বাবাই তো সংরক্ষণের খরচ দিচ্ছিলেন।
সরোগেসি পদ্ধতিটিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার না করা যায়, চিকিৎসা কেন্দ্রগুলির ওপরে নজরদারি রাখা এবং ভুক্তভোগী বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত পরিসর যাতে ব্যহত না হয় – এইসব কারণেই সারোগেসি আইন করা হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন।
বিচারপতি সিং মিজ আগরওয়ালের যুক্তি মেনে নিয়ে আদেশে লিখেছেন যে প্রীত ইন্দর সিং তার সংরক্ষিত শুক্রাণু ব্যবহার করে সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।
পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে তাই আদালত মনে করেছে যে মৃত পুত্রের সংরক্ষিত শুক্রাণু ওই দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া আটকানো যায় না।
মিসেস কউরের কাছে আদালতের ওই নির্দেশ “আশার আলো”, “যা আমাদের ছেলেকে আবারও ফিরিয়ে দেবে।”
“আমি প্রতিদিন প্রার্থনা করে গেছি যাতে আমার সন্তানের সব অপূর্ণ আশা পূরণ করতে পারি। চার বছর সময় লাগলেও আমার প্রার্থনা সফল হলো,” বলছিলেন মিসেস কউর।
Priyo Bangla 24 – Most Popular Bangla News The Fastest Growing Bangla News Portal Titled Priyo Bangla 24 Offers To Know Latest National And Local Stories.