এখন কোথায় আছেন ঢাকার চিফ হিট অফিসার বুশরা?

ঢাকার চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনকে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে একটি অফিস-রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ডিএনসিসি ভবনের ৬তলায় তাকে রুমটি দেওয়া হয়। তবে, অফিসের কার্যক্রমের জন্য বুশরা আফরিন ওই রুম একদিনও ব্যবহার করতে পারেননি।

গত ৫ আগস্ট থেকে তিনি আর ওই করপোরেশন ভবনে যাচ্ছেন না বলে ডিএনসিসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরআগে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র (বুশরার বাবা) মো. আতিকুল ইসলাম ঢাকার ওই অফিসারের জন্য (ক্ষমতাবলে) রুমটি বরাদ্দ করেন।

৫ আগস্টের দুইদিন আগে সাজসজ্জা ও যাবতীয় কাজ শেষে ওই রুম প্রস্তুত করে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ফলে নিজ অফিস-রুমে বসার ভাগ্য হয়নি বুশরা আফরিনের। ২০২৩ সালে চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান বুশরা। ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হয়ে তিনি কাজ করেছেন।

তবে, ডিএনসিসি থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আর্শট-রক) নিয়োগ দেন বুশরা আফরিনকে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর হিট অফিসার বুশরা আফরিনের আর খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এখন কোথায় আছেন তাও কেউ বলতে পারছেন না।

এদিকে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। বিনা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে মেয়ে বুশরা আফরিনকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চাকুরী দিয়েছেন। চাকরীর নামে তাকে প্রতি মাসে ৮ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হয়েছে। ডিএনসিসির হয়ে বুশরা আফরিন এক বছর তিন মাস কাজ করেছেন।

ওই হিসেব অনুযায়ী, ওই করপোরেশন থেকে বুশরা আফরিনের বেতন নেওয়ার পরিমাণ ১ কোটি প্রায় ২০ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ডিএনসিসির কোন কার্যক্রমেই দেখা মিলছে- না, বুশরা আফরিনের। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে তার খোঁজ নেই। ৫ আগস্ট থেকে তিনি আর নগর ভবনে ফেরেননি। এ হিট অফিসার কোথায় আছেন, কাজ করবেন কিনা-বিষয়টি জানেন না করপোরেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির জনসংযোগ বিভাগ জানায়, তাদের চিফ হিট অফিসার নামের কোন পদ বা অর্গানো নেয়। আর, ওই অফিসার পদে কোন ধরনের নিয়োগ বা পদায়নও হয়নি। কারণ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে অর্গানো নামে-এ ধরনের কোন পদই নেয়। বুশরার বেতন প্রসঙ্গে ওই বিভাগ জানায়, তার বেতনের বিষয়টির কোন সুযোগ নেই। আর্শট-রক নামের একটি বিদেশি সংস্থা তাপমাত্রা প্রশমনে ও পরামর্শের জন্য হিট অফিসার নিয়োগ করেছেন।

ওই সংস্থা বা ব্যক্তির সঙ্গে কোন কন্ট্রাক্ট-এমিও অথবা এগ্রিমেন্টে স্বাক্ষর করেনি ডিএনসিসি। তবে, সংস্থাটি ও চিফ হিট অফিসার শুধু ভলেন্টারি বিভিন্ন সময় ওই সিটি করপোরেশনকে পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান জনসংযোগ বিভাগ। বুশরা আফরিনের ব্যক্তিগত অফিস রুম প্রসঙ্গে ওই বিভাগ থেকে বলা হয়, তিনি (বুশরা) ডিএনসিসির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভবনে আসতেন। তবে, ভবনের ফ্লোরে তার ব্যক্তিগত অফিস-রুম ছিল না।

এদিকে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের অভিপ্রায় অনুযায়ী নিয়োগ পাওয়া সকলের চাকরি বাতিল করেছে ডিএনসিসি। সংস্থাটির সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক অফিস আদেশে উল্লেখ করেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়রের অভিপ্রায় অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার সিটি করপোরেশন আইন, ২০০৯ মোতাবেক নিয়োগকৃত সব উপদেষ্টা, পরামর্শক এবং কুক ও পিয়নের নিয়োগ গত ১৯ আগস্ট থেকে বাতিল করা হয়।

তবে ডিএনসিসি সূত্র জানান, বুশরা আফরিনের নিয়োগ বহাল আছে। কারণ তিনি সিটি করপোরেশন থেকে নিয়োগ পাননি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরশট-রকের সঙ্গে ঢাকার তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টায় যৌথভাবে কাজ করতে সমঝোতা আছে এ সিটি করপোরেশনের। আর চিফ হিট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন সাবেক মেয়রকন্যা বুশরা। তবে, আরশট-রকের পক্ষ থেকেও ঢাকায় তার কোনো অফিস নেই। ২০২৩ সালের ৩ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরশট-রকের সহযোগিতায় ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগ ও ডিএনসিসি যৌথভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সমঝোতা স্মারক অনুষ্ঠানে আতিকুল ইসলাম নিজেই মেয়ের এ পদে কাজ করার বিষয়টি জানান। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে তাপপ্রবাহ নিয়ে কাজ করার জন্য আরশট-রকের গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে সিএইচও হিসেবে বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটিকে নিরাপদ করার জন্য নেতৃত্বে দিচ্ছেন। তাপমাত্রা কমাতে কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়াও ঢাকা উত্তরের জনগণের মধ্যে তাপ সচেতনতা বৃদ্ধি, সুরক্ষা প্রচেষ্টা ত্বরান্বিতকরণে কাজ করার কথা তার। অবশ্য, চিফ হিট অফিসার নিয়োগ বিষয়ে আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়, কোনো দেশের সরকার তাপ নিয়ন্ত্রণের কাজকে অগ্রাধিকার দিলে স্থানীয় কর্মকর্তারা চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেবেন।

কোনো নগরের তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবিলায় মেয়র বা নেতৃত্বস্থানীয় অন্যরা চিফ হিট অফিসার পদ তৈরি করে এ পদে নিয়োগ দিতে পারেন। ডিএনসিসি সূত্র জানায়, সবশেষ একটি জরিপের কাজ করছিলেন বুশরা আফরিন। কাজটি শেষ পর্যায়ে থাকলেও শেষ হয়নি। এ কাজে প্রায়ই তিনি উত্তর সিটির নগর ভবনে আসতেন। সেখানে জরিপকাজে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণে যুক্ত থাকতেন। এছাড়া উত্তর সিটিতে পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল এবং স্বাস্থ্য বিভাগের নানা কর্মকান্ডে অংশ নিতেন বুশরা।

চলতি বছর প্রচন্ড হিটওয়েভ চলাকালীন সময়ে ওই হিট অফিসারের পরামর্শে ব্রাউজার মেশিন দিয়ে নগরীতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করেন সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ ছাড়া উত্তর সিটিতে গাছ লাগানো কর্মসূচিতেও হিট অফিসারের পরামর্শ ছিল বলে জানা গেছে। রাজধানীর বনানী এবং আগারগাঁও এলাকায় গ্রিন জোন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন অফিসার বুশরা। এ জন্য উত্তর সিটি করপোরেশন একটি প্রকল্পও নিয়েছিল।

গত ২৭ এপ্রিল সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় ব্রাজডার মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে তাপ কমানোর বার্তা দেন। সেটিকে কৃত্রিম বৃষ্টি বলে জানান তিনি। সেদিন মেয়র আতিকুল বলেন, চিফ হিট অফিসার আমাদের পরামর্শ দিচ্ছে। হিট অফিসার একজন একক ব্যক্তি। সে তো কাজগুলো বাস্তবায়ন করবে না। সে পরামর্শ দিচ্ছে কিন্তু কাজগুলো আমাদের সবাইকে করতে হবে। তার পরামর্শেই জনগণকে স্বস্তি দিতে আমরা এই কাজগুলো করছি।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনসহ অন্য মেয়রদের অপসারণ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, নানা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ অন্যান্য মামলা আছে। হত্যাসহ অন্য মামলার তালিকার ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম আছেন। এখন তিনি কারাগারে আছেন। গত ৫ আগস্টের পর তিনি গা ঢাকা দেন। ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মহাখালী থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

আদালত সূত্র জানান, আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অভিযোগ ছিল, বিনা চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে নিজের কন্যাকে হিট অফিসার নিয়োগ দেন আতিকুল ইসলাম। ওই আইনজীবীরা বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে বুশরা আফরিনকে মাসে ৮ লক্ষ টাকা বেতন দেওয়া হতো।

এবিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনকে আমরা নিয়োগ দেইনি। তাকে ‘আর্শট-রক’ সংস্থাটি নিয়োগ দিয়েছে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বুশরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। তাকে যেহুতু আমরা নিয়োগ দেয়নি-তাকে বেতন দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বুশরা কি কারণে সিটি করপোরেশন ভবনে আসছে না-সেটি তিনিই জানেন। বিষয়টি তো আমাদের জানার কথা না। সে তো আমাদের কেউ নন। তিনি কাজ করবে কি করবেন না আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশনের বিষয়।