সব ঋতুতেই যেন ফলবতী পাবনার মাঠ। ফসলি জমিতে সবজির সমারোহ। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরলে চোখে পড়বে হরেক রকমের ফলের বাগান। অধিকাংশ সবজি ও ফলের বাগান করেছেন শিক্ষিত তরুণরা। চাকরির পেছনে না ঘুরে সবজি ও ফলচাষে স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা। একজনকে দেখে এ পথে পা বাড়িয়েছেন বহু তরুণ-যুবক। ফলে নীরব সবজি বিপ্লব ঘটেছে পাবনায়।
জেলাটিতে এ সবজি বিপ্লবের নায়ক ঈশ্বরদীর ছলিমপুর গ্রামের চাষি শাহজাহান আলী বাদশা। মাত্র দুই বিঘা জমিতে সবজি চাষ শুরু করেছিলেন তিনি। বর্তমানে তার খামারের আয়তন প্রায় ২০০ বিঘা। পেয়েছেন কৃষিতে ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’ ও ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’। এ বছর এআইপি (এগ্রিকালচারাল ইমপরটেন্ট পারসন) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বাদশা। তার দেখানো পথে স্বাবলম্বী হয়েছে জেলার শতাধিক যুবক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর, জগন্নাথপুর, ছলিমপুর, বক্তারপুর, চরকালামপুর, চরকুরুলিয়া, ডিগ্রীরচর, চরগরগরি, চরকাৎরা ভারইমারী, পাকুরিয়া, কাঠালবাড়ীয়া, দাশুড়িয়া, পুড়ারদাইরে মাঠের পর মাঠ সবজি বাগানে সাজানো। এরমধ্যে বেশি চোখে পড়ে পেঁপে বাগান। ছোট ও মাঝারি আকারের গাছ পেঁপেতে ঠাসা।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলার ঈশ্বরদীতেই বছরে প্রায় তিন হাজার বিঘা জমিতে পেঁপে চাষ হচ্ছে। আশির দশকের পর থেকেই ঐতিহ্যবাহী এ উপজেলায় পেঁপের চাষ বাড়তে থাকে। নব্বই দশকে ঈশ্বরদীর কিছু এলাকা পেঁপেপল্লিতে পরিণত হয়। পেঁপে চাষে বিপ্লব ঘটান আজকের এআইপি শাহজাহান আলী বাদশা। পেঁপে চাষে জেলায় তিনি এতটাই পরিচিত হয়ে ওঠেন যে সবাই তাকে ‘পেঁপে বাদশা’ নামে চেনেন।
শাহজাহান আলী বাদশা জানান, তিনি ১৯৭৭ সালে মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর ছলিমপুরে বাবার ৪-৫ বিঘা জমিতে আলু, টমেটো, গাজর, বেগুনসহ বিভিন্ন শাক-সবজির চাষ শুরু করেন। শুরুতেই তিনি বেগুনচাষে সাফল্য পান। দুই বিঘা জমিতে বেগুনচাষে তৎকালীন সময়ে ৩৩ হাজার টাকা লাভ হয় তার। সেই থেকেই সবজি চাষকে পেশা হিসেবে নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি জানান, ১৯৮৮-৮৯ সালে অন্যের জমি লিজ নিয়ে ৮০ বিঘা জমিতে শাক-সবজি আবাদ করেন। এতে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি স্বর্ণপদক পদক লাভ করেন। বর্তমানে তিনি প্রায় ২০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন ‘মা-মনি কৃষি খামার’। যেখানে প্রায় ৩৫ ধরনের সবজি ও ১০-১৫ জাতের ফলের চাষ হচ্ছে। গড়ে তুলেছেন একটি ডেইরি ফার্মও।
দেশের মধ্যে বাদশা প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শরিফা বাগানের চাষ করছেন। তার খামারে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন আরও অনেক পরিবার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বারি, বিনা, বিএডিসি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় তিনি আজকের অবস্থানে উঠে এসেছেন।
শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, ‘আমরা আগ্রহ সবসময় নতুন নতুন ফল ও সবজিচাষের প্রতি। আমি এ কাজে এসে শুধু লাভবান হইনি। বহু চাষিকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ চাকরির পেছনে না ছুটে সবজি বা ফলের চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন।’
চাষিদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত জরুরি
বাদশা এখন দেশের চাষিদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি। তিনি শুধু নিজের খামার নিয়ে ব্যস্ত থাকেননি। সারাদেশের চাষিদের সমস্যা নিয়ে ভাবেন বাদশা। এ লক্ষে গড়ে তুলেছেন ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন।
এক দশক আগে ‘নিরাপদ খাদ্য আমরাই দেবো’ অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) যাত্রা শুরু। এ সংগঠনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি বিষমুক্ত খাদ্য পৌঁছে দেওয়া। তবে খাদ্য নিরাপত্তা বা নিরাপদ খাদ্য পেতে হলে চাষিদেরও আর্থিক নিরাপত্তার দরকার বলেও জানান বাদশা।
শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, চাষি ও ভোক্তাদের কল্যাণে বিএফএ সারাদেশে বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করে রাসায়নিক ও বিষমুক্ত সবজি ও ফল উৎপাদন করে ঢাকায় সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। ঢাকায় বিএফএ’র নিজস্ব আড়তের মাধ্যমে তা বাজারজাতকরণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে চাষি ভালো দাম পাওয়ার পাশাপাশি ভোক্তারাও নিরাপদ খাদ্য পাবেন।
এদিকে, শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। কৃষিপণ্য কেনার সময় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেনেন। চাষিদের টিকে থাকার জন্য অধিকার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। চাষিদের বাঁচাতে হলে প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। বাজেট প্রণয়নেও কৃষকের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাদশা বলেন, উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকের দুরবস্থা চলছে। খুচরা ও পাইকারি বাজারমূল্যের বিশাল ব্যবধানে চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও বছরের পর বছর কৃষক লোকসান গুনছেন। কৃষিসংকট কৃষকের জীবনের সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বহু প্রান্তিক কৃষক নিঃস্ব হয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তরুণ-যুবকদের জন্য খোলা এআইপি বাদশার দরজা
চাকরি না পেলে হতাশা নয়। বরং শাক-সবজি বা পেঁপে চাষে মনোযোগী হয়েও ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব। আগ্রহী সবজি চাষিদের মধ্যে নিজের অভিজ্ঞতা বিলিয়ে দিতেও সবসময় আন্তরিক বাদশা। তিনি বলেন, ‘আগ্রহী সবার জন্য আমার দরজা খোলা।’
এআইপি মর্যাদা পাওয়া প্রসঙ্গে বাদশা বলেন, কৃষকের মর্যাদার জন্য আমি ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলাম। তাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সুন্দর উদ্যোগ নিয়েছে। এখন চাষিরা তাদের শ্রমের মর্যাদা পাচ্ছেন। সিআইপির মতো এআইপিরাও এখন নানা সুযোগ-সুবিধা লাভ করবেন। এতে তিনি যেমন খুশি, তেমনি তার এলাকার ও সারাদেশের কৃষকরা খুশি। কারণ এখন প্রতি বছরই কিছু চাষি এআইপি মর্যাদা পেতে থাকবেন।
জানতে চাইলে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষিতে পাবনা একটি অগ্রসর জেলা। এখানে কৃষির যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে, তেমনি অনেক খ্যাতিমান চাষিও রয়েছেন। যাদের অনেকেই জাতীয় পদকপ্রাপ্ত কৃষক। গত বছর থেকে সরকার কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখা চাষিদের এআইপি মর্যাদা দেওয়া শুরু করেছেন। এতে পাবনার দুজন চাষিও রয়েছেন। আগামীতেও পাবনার চাষিরা এআইপি মর্যাদা পাবেন বলে আশা করি।’