পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে দিনমজুরি ও রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন কিশোর আকবর আলী। তবে পরিবারে টানাটানি লেগেই থাকত। সে জন্য ১৮৬৭ সালে বাবা খোশবান আলী এবং দুই ভাই রুস্তম আলী ও ইয়াকুব
আলীর হাত ধরে মুর্শিদাবাদ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় চলে আসেন আকবর আলী। পাবনার ঈশ্বরদীতে রাজমিস্ত্রির কাজ নেন আকবর আলী। অনেক দিন কাজ করার পর সেখান থেকে সপরিবার তখনকার জয়পুরহাট মহকুমা শহরের বানাইচ গ্রামে আসেন। সেখানেও রাজমিস্ত্রির কাজ নেন
ভাগ্যবদলের আশায় শূন্য পকেটে ১৮৮৮ সালে সপরিবার বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জপাড়ার একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন আকবর আলীরা। সেখানেও শুরুতে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। পরে ‘রসগোল্লা’ বিক্রি শুরু করেন। তাতেও
ঠিকমতো সংসার চলত না। সে কারণে ১৮৯০ সালে ৩০ টাকা পুঁজি নিয়ে শহরের বাদুড়তলায় চকযাদু সড়কে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেন। সেটিই ছিল বগুড়া শহরের প্রথম মুসলিম রেস্তোরাঁ। অল্প সময়েই রেস্তোরাঁটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
জনশ্রুতি আছে, বগুড়ার নওয়াব পরিবারের সদস্যরাও সেই রেস্তোরাঁয় আসতেন। নওয়াব পরিবারের প্রতি সম্মান জানাতে আকবর আলী রেস্তোরাঁর নাম দেন ‘মোহাম্মদ আলী রেস্টুরেন্ট’। ১৯০১ সালে কবি নজরুল ইসলাম সড়কে মাসিক ৫০ টাকায় একটি ঘর ভাড়া নিয়ে মুসলমানদের জন্য আকবরিয়া হোটেল চালু করেন তিনি। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৭৫ সালে আকবর আলী মারা গেলে ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর ছেলেরা। পরে সব ভাই মিলে হাসান আলী আলালের হাতে প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব তুলে দেন। তিনিই আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান। তবে ১৩১ বছর পরে আজ
আকবর আলীর প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁ ব্যবসা সম্প্রাসারিত হয়ে বগুড়ার শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। আকবরিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সংখ্যা ২৪। এসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিস্কুট, পাউরুটি, চানাচুর, কেক, জন্মদিনের কেক, মিষ্টি, দই ও লাচ্ছা সেমাই, চিকন সেমাইসহ অনেক রকমের পণ্য উৎপাদন করে।
বর্তমানে আকবরিয়া গ্রুপে কাজ করেন প্রায় আড়াই হাজার কর্মী। তাদের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ বর্তমানে ২৫০ কোটি টাকা। সম্পদের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা, এমনটাই জানালেন আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী।
আকবরিয়া গ্রুপের যত প্রতিষ্ঠান
আকবরিয়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, আকবরিয়া আবাসিক হোটেল, আকবরিয়া মিষ্টি মেলা, আকবরিয়া এক্সক্লুসিভ সুইটস, আকবরিয়া অ্যাডমিন ক্যাফে, আকবরিয়া টার্মিনাল ক্যাফে, হ্যালো
আকবরিয়া, আকবরিয়া কেক ইম্পিরিয়াম, আকবরিয়া ডেইরি ফার্ম, আকবরিয়া ফ্লাওয়ার মিলস, আকবরিয়া লাচ্ছা সেমাই, আকবরিয়া প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড প্যাকেজিং, আকবরিয়া পলি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, আকবরিয়া
কুকিজ অ্যান্ড প্রিমিয়াম ফুডস, আকবরিয়া ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি, আকবরিয়া অটো বিস্কুট ফ্যাক্টরি, আকবরিয়া ড্রান্সিং কাপ, আকবরিয়া ক্যাফে আড্ডা, আকবরিয়া চারমাথা রেস্টুরেন্ট, আকবরিয়া মাঝিড়া রেস্টুরেন্ট,
আকবরিয়া দই কারখানা, আকবরিয়া মেডিকেল ক্যানটিন ও আকবরিয়া প্লাস। এ ছাড়া যাত্রা শুরু করেছে আকবরিয়া কেয়ার লিমিটেড। বগুড়া ছাড়াও রংপুরে আছে আকবরিয়া গ্রুপের ৩১টি বিক্রয়কেন্দ্র। ঢাকার ধানমন্ডি ও মিরপুরে দুটি, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে আছে চারটি ফ্রাঞ্চাইজি। খাদ্য পরিবহনের বহরে গাড়ির সংখ্যা এখন শ খানেক।
সম্প্রতি এক দুপুরে শহরের দত্তবাড়ির বগুড়া ট্রেড সেন্টারের আকবরিয়া গ্রুপের করপোরেট কার্যালয়ে হাসান আলী আলাল ও তাঁর ভাইদের সঙ্গে কথা হয়। হাসান আলী আলাল জানান, ব্যবসায় হঠাৎ করে খারাপ সময় চলে আসে। তখন বিদেশে পড়াশোনায় ইতি টেনে দেশে ফিরে পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরেন। তাঁর ইচ্ছা আকবরিয়া গ্রুপ হাজার বছর টিকে থাকুক। আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হোক। সে জন্যই ব্যবসা সম্প্রসারণ করে চলেছেন। তবে নেতৃত্ব সব সময় নিজের কাছে রাখতে চান না তিনি।
আকবরনামা
১২ বছরের কিশোর দিনমজুর ও রাজমিস্ত্রির জোগালি আকবর আলী ১৮৬৭ সালে খালি পকেটে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে পদ্মা পার হয়ে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে আসেন। নৌকা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে এলেন ঈশ্বরদীতে। কয়েক দিন কাটল রেল জংশনেই। ক্ষুধা মেটান দুই পয়সার ছাতু আর পানি খেয়ে।
এরপর আকবর আলী রাজমিস্ত্রির কাজ শুরু করলেন। ভাগ্যান্নেষণে পরে এলেন বগুড়া জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার বানাইচ গ্রামে। পরিচিত একজনের মাধ্যমে পরে বগুড়ায় এসে উঠলেন সুলতানগঞ্জপাড়ায়। রাজমিস্ত্রির সেই পুরোনো পেশা। কিন্তু কাজ তেমন না থাকায় তিনি ফেরি করে রসগোল্লা বিক্রি শুরু করেন। রসগোল্লা বাকিতে কিনে শহরের মহল্লা ঘুরে ফেরি করে তা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতেন। এক রসগোল্লার দাম তখন ৫-১০ পয়সা। দিন শেষে মুনাফা হতো চার-পাঁচ টাকা। তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলত না।
হাসান আলী জানান, একসময় রসগোল্লা বিক্রি করা ছেড়ে দিয়ে শহরের বাদুড়তলা এলাকায় হোটেল দেন তাঁর বাবা আকবর আলী। এরপর ১৯০১ সালের দিকে কবি নজরুল ইসলাম সড়কে আকবরিয়া হোটেলের যাত্রা শুরু পাঁচজন কর্মচারী নিয়ে। আকবর আলীর জন্ম ১৮৫৫ সালে, মৃত্যু ১৯৭৫ সালে।
আকবরিয়া থেকে গ্র্যান্ড হোটেল
বাবা আকবর আলী শুরু থেকেই হোটেলে নবাবি ও খানদানি পরিবেশে খাবার পরিবেশন করতেন। পাথরের টেবিল, খানদানি চেয়ার, খাবার পরিবেশনে কড়ির প্লেট আর চোখধাঁধানো আসবাব ছিল হোটেলে। বগুড়া শহরে তখন বিদ্যুৎ ছিল না, তাই আকবরিয়ার ছিল নিজস্ব বৈদ্যুতিক জেনারেটর ব্যবস্থা। হরেক পদের নবাবি খাবার রান্নার জন্য ভারত থেকে বাবুর্চি নিয়ে আসা হয়েছিল, খাবার পরিবেশনকারী বয়-বেয়ারা শেরওয়ানি, পাগড়িসহ নবাবি পোশাক পরতেন। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকারের একজন ম্যাজিস্ট্রেট আকবরিয়াকে ‘গ্র্যান্ড হোটেল’ হিসেবে স্বীকৃতির সনদ দেন।
বগুড়ার ‘বিউটি বোর্ডিং’
পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ের মতোই উত্তরবঙ্গের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, ডাকসাইটে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীরা একসময় আকবরিয়া হোটেলে আড্ডা দিতেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি আছে এই আকবরিয়াতে। ঢাকার বড় বড় রাজনীতিবিদ, শিল্পী-সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র অঙ্গনের লোকজনও উত্তরবঙ্গে এলেই আকবরিয়ায় খেতে আসতেন।
আকবর আলীর ঘর-সংসার
আকবর আলী রেস্তোরাঁ ব্যবসা করার সময়ই প্রথমে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় সাজেদা বেগম নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। এ পক্ষে সন্তান না হলে পরে জয়পুরপাড়ায় রাবেয়া খাতুন নামের আরেকজনকে বিয়ে করেন। ছোট স্ত্রীর ছয় ছেলের মধ্যে বড় ছেলে শাহজাহান আলী এবং আরেক ছেলে সিদ্দিকুর রহমান শুরু থেকেই বাবার সঙ্গে ব্যবসা দেখভাল করতেন। ১৯৭৫ সালে আকবর আলী মারা যাওয়ার পর অন্য ছেলেদের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন তোতা, শাহানুর ইসলাম শাহীন ব্যবসায় যুক্ত হন। সবশেষে ব্যবসায় যুক্ত হন যমজ দুই ভাই হাসান আলী আলাল ও হোসেন আলী দুলাল।
অবশেষে উত্থানপর্ব
আকবর আলীর মৃত্যুর পর ব্যবসা লোকসানে পড়ে। ছোট ছেলে হাসান আলী তখনো বগুড়া জিলা স্কুলের ছাত্র। স্কুলে পড়াবস্থায় ১৯৮৫ সালে তিনি আকবরিয়া ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরি চালু করেন। শুরুতে হোটেলের সামনে ও পরে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে করে নাটোরের সিংড়া পর্যন্ত বিস্কুট, পাউরুটি ও চানাচুর বিক্রি করতেন হাসান আলী। ব্যবসার ফাঁকে পড়াশোনা করেই বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি ও বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় পড়তে যান। ভর্তি হন বায়োক্যামিস্ট্রিতে। তখন ব্যবসায় টালমাতাল অবস্থা।
তাই দেড় বছরের মাথায় দেশে ফিরে আসেন হাসান আলী। ১৯৯০ সালের দিকে আকবরিয়া দায়দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। ওই দুঃসময়ে ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। হোটেল ব্যবসার পাশাপাশি ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট, দই-মিষ্টি, কেক ইত্যাদি উৎপাদন ও বিপণনে মনোযোগ দেন। নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেন, হোটেলের শাখা বাড়ান। এতে ধীরে ধীরে সাফল্য আসতে শুরু করে। একে একে প্রতিষ্ঠা করেন আকবরিয়া গ্রুপের ২৪টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। পেডালচালিত একটি ভ্যানের জায়গায় এখন আকবরিয়ার পণ্য বিপণন ও পরিবহনে শ খানেক ট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান হয়েছে।
হাসান আলী বলেন, ২০০২ সাল পর্যন্ত আকবরিয়া পরিবারে কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। পণ্য সরবরাহের পিকআপ ভ্যানে চড়েই পরিবারের সদস্যরা বেড়াতে যেতেন, হোটেলে যাতায়াত করতেন। এখন পরিবারের সদস্যরা একাধিক দামি গাড়িতে চড়েন।
বাবাই ছেলের প্রেরণা
হাসান আলী বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবসা বন্ধ হলে হোটেলের সামনে বেঞ্চ পেতে বাবা পাউরুটি-কলা বিক্রি করতেন। বাবার সেই সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েই হোটেলের এক পাশে পাউরুটি-বিস্কুট বিক্রি শুরু করি।’ তিনি বলেন, ‘পায়ে হেঁটে হোটেলে এসেছি, হোটেল থেকে হেঁটে কারখানায় যেতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করেছি। ব্যবসার খারাপ দিনগুলোতে নানা জায়গায় গিয়ে মানুষের কাছে পা পর্যন্ত ধরেছি, অনেক ছোট হয়েছি। নানা লাঞ্ছনা সয়েছি। কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছি।’
হাসান আলী বলেন, ‘সামনে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে চাই। আকবরিয়া হবে খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। আকবরিয়ার পণ্য বর্তমানে উত্তর-দক্ষিণবঙ্গ ছাড়াও ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে বিপণন হচ্ছে। এর বাজার সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। আকবরিয়ার চিকন সেমাই, লাচ্ছা সেমাই এবং দই-মিষ্টি ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে। ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে পণ্য রপ্তানি করতে চাই। বর্তমানে ঈদে আকবরিয়ার ১০ কোটি টাকার সেমাই বিক্রি হচ্ছে। সেটি শতকোটিতে সম্প্রসারণ করতে চাই। দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি আমরা।’