বান্দরবান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুরে ভিক্ষা করেছেন খুলনার আলোচিত রহিমা বেগম। ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুর পৌনে ১টার দিকে ইসলামপুরের বাসিন্দা কামরুন্নাহার মনির ঘরোয়া হোটেলে ভিক্ষার জন্য যান তিনি। এসেই হোটেলের মালিক মনিকে বলেন, ‘মা আমাকে কিছু ভিক্ষা দাও’।
ভিক্ষার সূত্র ধরেই মনির কাছে আশ্রয় পেয়ে যান রহিমা। থাকেন চার দিন। নাম রহিমা বললেও মনিকে বাড়ির ঠিকানা দিয়েছেন ফরিদপুর। রহিমার সঙ্গে পরিচয় ও বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার বিস্তারিত বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন কামরুন্নাহার মনি।
কামরুন্নাহার মনি ইসলামপুরে নিজের বাড়িতে খাবার তৈরি করে ঘরের এক পাশে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে বিক্রি করেন। স্বামী ও এক সন্তান নিয়ে তার সংসার। তিন মাস আগে হোটেলের ব্যবসা শুরু করেন। মা নেই, বাবা নবী হোসেন (৭০) কোনও কাজ করতে পারেন না। পাঁচ বোনের মধ্যে চতুর্থ মনি। হোটেলের আয় দিয়ে সংসার চলে তার।
যেভাবে রহিমার সঙ্গে মনির পরিচয়
মনি বলেন, ‘১৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমার হোটেলের সামনে এসে রহিমা বলেন, মা আমাকে কিছু ভিক্ষা দাও। তার কথা শুনে মনে হয়েছিল অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য টাকা চাইতে এসেছেন। পরে দেখি সুস্থ। হোটেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলি, খালা কি লাগবে আপনার?। তখন রহিমা বলেন, চাল দাও, নয়তো টাকা দাও। আমার দোকানে তখন তিন জন কাস্টমার ছিলেন, তারা ভাত খাচ্ছিলেন। তাদের সামনে আমি রহিমাকে ২০ টাকা ভিক্ষা দিই। আমার দেওয়া দেখে তিন কাস্টমার ১০ টাকা করে ৩০ টাকা ভিক্ষা দেন। চাল লাগবে কিনা জানতে চাইলে রহিমা বলেন, আমি সবকিছু ভিক্ষা নিই। তখন তাকে একবাটি চাল দিই। এরপর চলে যাচ্ছিলেন রহিমা।’
যেভাবে মনির বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন রহিমা
মনি বলেন, ‘ভিক্ষা নিয়ে কিছু দূর চলে যাওয়ার পর ওই বৃদ্ধা নারীর জন্য আমার মায়া হয়। ডাক দিয়ে বলি, খালা এদিকে আসেন। হোটেলের ভেতরে এনে জানতে চাই, কোথায় থাকেন? তখন বলেন, বান্দরবানের ৭ নম্বর পৌর এলাকার আর্মিপাড়ায়। ওই এলাকায় আপনাকে কখনও দেখিনি জানালে রহিমা বলেন, আমি তিন মাস ধরে থাকি। এজন্য দেখা হয়নি। তাকে বলি খালা, ইসলামে ভিক্ষা করা জায়েজ নেই, আপনি সুস্থ মানুষ কাজ করে খেতে পারেন, কেন ভিক্ষা করেন? উত্তরে রহিমা বলেন, মা আমার থাকার জায়গা নেই, কেউ তো ইচ্ছে করে ভিক্ষা করে না। আমি পরিস্থিতির শিকার। পরে তাকে বলি, আমার মা নেই, মারা গেছেন। আপনি আমার এখানে থাকতে চাইলে রাখবো। এই কথা শুনে রহিমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমিও অনেক মানুষকে থাকার জায়গা দিয়েছি, পরিস্থিতির কারণে আজ আমার এই অবস্থা। পরে ভিক্ষার চালগুলো ৩৫ টাকা কেজিতে আমাকে কিনতে বলেন। মেপে দেখি দুই কেজি ২৫০ গ্রাম চাল। তাকে চালের দাম ৭০ টাকা দিই। এ সময় দুই টাকা, পাঁচ টাকা ও ১০ টাকার নোটসহ ভিক্ষার ২০০ টাকা আমার কাছে জমা রাখেন। বিকালে আমি আর্মিপাড়া থেকে তোমার এখানে চলে আসবো—এই বলে চলে যান।’
মনি আরও বলেন, ‘ওই দিন বিকালে আমার বোনের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের পৌর শাখায় গিয়েছিলাম। ওই সময় আমার বান্ধবী ফোনে জানায়, তোর বাসায় এক বৃদ্ধা নারী এসেছেন। তখন আমি বান্ধবীকে বলি, তাকে বসিয়ে রাখ, আমি আসতেছি। বাসায় এসে দেখি চেয়ারে বসা। সঙ্গে একটা ব্যাগ, পরনে খয়েরি রঙের পায়জামা, গোলাপি কামিজ ও সবুজ ওড়না ছিল। পরে আমি তাকে হলুদ রঙের একটা ওড়না দিই, ফরিদপুর থেকে উদ্ধারের সময় আমার দেওয়া ওড়নাটি তার গায়ে ছিল।’
মনি বলেন, ‘রহিমাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার পর বলি, যদি এখানে স্থায়ীভাবে থাকেন তাহলে দোকানে যেসব মালামাল আনবো তা বিক্রি করবেন, মা হিসেবে আমাকে সহযোগিতা করবেন। আমি আপনাকে মা হিসেবে সম্মান করবো। এতে রাজি হন রহিমা। আমার বাসায় চার দিন ছিলেন। তবে প্রতিদিন সকাল ৬টার দিকে কাজের কথা বলে বেরিয়ে যেতেন। সকাল ৯টা কিংবা সাড়ে ৯টার দিকে এসে আমাকে কাজে সহযোগিতা করতেন। তিনি সহযোগিতা না করলেও তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। এজন্য কোথায় যেতো তাও জানতে চাইতাম না। একদিন জানতে চাইলে বলেছেন, একটা কাজে আর্মিপাড়ায় গিয়েছিলাম। এরপর আর জানতে চাইনি। অসহায় মা হিসেবে তাকে খাবার ও আশ্রয় দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এজন্য তার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইনি।’
কামরুন্নাহার মনি
তিনি বলেন, ‘১৫ সেপ্টেম্বর রাতে আমার ছেলের জন্মদিন পালন করেছি। ওই দিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে চরমোনাই পীরের মাহফিল থাকায় সেখানে চলে যান রহিমা। যাওয়ার আগে বলেছিলেন, চরমোনাই পীর রহিমার বাবার ওস্তাদ। তাকে দেখার জন্য মাহফিলে যাচ্ছেন। রাত ১১টার দিকে মাহফিল থেকে বাসায় ফেরেন। এরপর খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে কাজের কথা বলে বেরিয়ে যান। ৯টার দিকে এসে আমাকে বলেন, আমি আজ চলে যাবো। কোথায় যাবেন? আমি মায়ের জন্য প্রতিদিন কান্না করি, আপনাকে আল্লাহ আমার জন্যই এখানে এনেছেন, আপনাকে কোথাও যেতে দেবো না। তখন রহিমা বলেন, এখানের ক্যান্টনমেন্টে একটা চাকরি পেয়েছি, ভাত রান্না করবো। তারা আমার আইডি কার্ড চেয়েছেন। ফরিদপুরে যাবো এবং আইডি কার্ড নিয়ে আবারও তোমার কাছে আসবো। ওই দিন গরুর মাংস রান্না করেছিলাম, তা দিয়ে আমার সঙ্গে ভাত খেয়েছিলেন। যাওয়ার সময় আমার কাছে জমা রাখা ২০০ টাকা, গাড়ি ভাড়ার জন্য আরও ২০০ টাকা নিজের থেকে দিয়েছি। আমার ছেলে এবং ভাগনে বাসস্ট্যান্ডের কাছে হিলটন হোটেলের সামনে তাকে পৌঁছে দেয়। সড়কের পাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে এসব সত্য বেরিয়ে আসবে। রহিমা আমার কাছে থাকাকালীন বলেছেন, মা তোমার কষ্ট দেখে আমার কষ্ট ভুলে গেছি।’
মনি আরও বলেন, ‘রহিমাকে উদ্ধারের সময় পুলিশ যে লাল রঙের শপিং ব্যাগ পেয়েছিল, সেখানের ভেতরে সাদা কাগজে দুটি নম্বর ছিল। ৫২ মনি দিয়ে লেখা নম্বরটি আমার। ফরিদপুরে ঠিকমতো পৌঁছানোর পর আমাকে জানাতে বলেছি, কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাকে কিছুই জানাননি।’
তিনি বলেন, ‘আমার এখানে ইতোপূর্বে পাগল, অসহায় ও দরিদ্র এমন অনেক মানুষ ছিল এবং চলেও গেছেন। এলাকার সবাই জানে আমি অসহায় মানুষকে থাকার জায়গা ও সহায়তা দিই। উদ্ধারের আগ পর্যন্ত রহিমার বিষয়ে কিছুই জানতাম না। তিনি আমার কাছে থাকা অবস্থায় অনেকবার ফেসবুকে দেখেছি, মরিয়ম তার মায়ের জন্য কান্না করছেন। কিন্তু রহিমা যে মরিয়মের মা তা জানতাম না। কারণ ফেসবুকে দেওয়া মরিয়মের মায়ের ছবি আর রহিমার চেহারার মিল খুঁজে পাইনি। এটা কল্পনারও বাইরে ছিল। উদ্ধারের পর আমার বান্ধবী উর্মি জানায়, তোর বাসায় যে বৃদ্ধা ছিলেন, তার ছবির সঙ্গে ফরিদপুরে উদ্ধার নারীর ছবিটা মিলিয়ে দেখ। তখন ছবি মিলিয়ে দেখি আমার বাসায় থাকা রহিমাকেই ফরিদপুর থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। বিষয়টি দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়েছি।’
মনির বান্ধবী উর্মি বলেন, ‘রহিমাকে উদ্ধারের সংবাদ ফেসবুকে দেখে মনিকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানাই। কারণ মনির বাসায় যে রহিমাকে দেখেছি, তার সঙ্গে পুরোপুরি মিল রয়েছে উদ্ধার নারীর। তার গায়ের হলুদ রঙের ওড়নাটি আমার বান্ধবীর। এরপরও নিশ্চিত হতে ফোন দিয়েছিলাম। পরে ছবি মিলিয়ে মনি আমাকে ফোন দিয়ে জানায় তার বাসায় থাকা ওই নারীই রহিমা। সব জেনে অবাক হয়েছি, মানুষ কীভাবে এমন প্রতারণার আশ্রয় নেয়।’
ইসলামপুরের বাসিন্দা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে রহিমাকে মনির হোটেলে কাজ করতে দেখেছি। পরে শুনেছি, রহিমা মরিয়মের মা। যাকে নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। তবে রহিমা কীভাবে এখানে এলেন তা আমরা জানি না।’
একই এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে অসহায় মানুষকে কাজ দেন মনি। সেইসঙ্গে বাড়িতে আশ্রয় দেন। ওই সুযোগে মনির বাসায় আশ্রয় পেয়ে যান রহিমা। হয়তো কারও কাছ থেকে শুনে সহায়তার আশায় মনির কাছে গিয়েছিলেন। তবে তাকে এর আগে এখানে দেখিনি।’
রহিমা আর্মিপাড়ায় ছিলেন না
রহিমা আর্মিপাড়ায় ছিলেন কিনা জানতে চাইলে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহানা আক্তার শানু বলেন, ‘রহিমা নামের কেউ আর্মিপাড়ায় ছিলেন না। ওখানের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারাও রহিমার বিষয়ে কিছুই জানেন না। এরপরও আমি এ বিষয়ে আরও খোঁজখবর নেবো।’
সেদিন চরমোনাই পীরের মাহফিল গিয়েছিলেন রহিমা?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সেলিম রেজা বলেন, ‘মনির বাসায় থেকেছেন রহিমা, এটা সত্য। চার দিন ছিলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে চরমোনাই পীরের মাহফিল হয়েছিল। সেখানে নারীদের জন্য আলাদা প্যান্ডেলের ব্যবস্থা ছিল না। খোলা মাঠে মাহফিল হয়েছিল। কীভাবে রহিমা মাহফিলে এসেছেন তা আমার জানা নেই। এত রাত পর্যন্ত তিনি মাহফিলে ছিলেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
যা বলছে পুলিশ
রহিমা চার দিন মনির বাসায় ছিলেন পুলিশ জানতো কিনা জানতে চাইলে বান্দরবান সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মির্জা জহির উদ্দিন বলেন, ‘রহিমা এতদিন বান্দরবান এবং শেষ কয়েকদিন মনির বাড়িতে ছিলেন বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেবো আমরা।’
রহিমা ‘নিখোঁজ’ মামলার তদন্ত কতদূর এগিয়েছে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আব্দুল মান্নান বলেন, ‘তদন্তকাজ চলছে এখনও। ফরিদপুরে গিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। বান্দরবানে এখনও যাইনি। ওখানে গিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করবো।’