বেহালার পান বিক্রেতা দোকানে বসেই লিখে ফেলেছেন দু’হাজারেরও বেশি গল্প!

দারিদ্রতার স্রোতে বহু স্বপ্ন ভেসে চলে গিয়েছে বহুদূরে। খুব কম মানুষই পারেন সব বাধা পেরিয়ে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে। এমনই এক পান বিক্রেতার স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। তবে থেমে থাকেননি তিনি।

ইতিমধ্যে লিখে ফেলেছেন ১১টি উপন্যাস, ২০০টি গল্প, ২০০টি কবিতা এবং প্রায় ১০০টি প্রবন্ধ। শুধু কি তাই? লিখেছেন বহু মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো গদ্য। বেহালা চৌরাস্তার মদনমোহনতলা বাজারে ছোট্ট গুমটিতে পান বিক্রি করেন বছর চুয়াল্লিশের পিন্টু।

বাংলায় ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। পড়াশুনা করতেন দোকানে বসেই। বহু উচ্চ শিক্ষিত খদ্দের দোকানে এসে চাকরির আশা দেখালেও, পূরণ করেনি কেউই। তবে নিজের মনের জোরে পড়াশুনা শেষ করেছেন এবং বিগত ৩০ বছর ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন তিনি। পিন্টু বাবু জানান, “আমি যখন ক্লাস ৩-৪ এ পড়তাম তখন লেখার চেষ্টা করতাম। ছোটবেলায় মনে হত আমার লেখাও সবাই পড়বে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর একসময় নিজের লেখাগুলো সব ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম রাগে। নিজে লিখলেও মনের মতো হত না।”

উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই এই পানের দোকান খোলেন তিনি। তবে দোকান চালানোর পাশাপাশি পড়ালেখা চালানো দুষ্কর হয়ে উঠছিল। কারণ দোকানে বসে বই লেখার সময় বিদ্রুপ ছাড়াও অনেক সমস্যা হত। তবে এত মানুষের ভিড়ে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গিয়েছেন। “আমি কৃতজ্ঞ সাংবাদিকদের কাছে। কারণ তার আগে যা ব্যবহার পেয়েছি তাতে মনে হত আমি খুবই সাধারণ বা বাস্তবকে ভুলে গিয়ে কোনও ভুল কাজ করছি।

সেখানে সাংবাদিকরা আমাকে সম্মান দিয়েছেন”, জানান পিন্টু পোহান। খেটে খাওয়া মানুষদের এখনও ছোট চোখে দেখা হয়। আর এই বিভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চান পিন্টু বাবু। তাঁর মতে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, পেশার ভিত্তিতে যেন সকলকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া হয়। কারণ মানুষ এমনও বলেছেন, “যার ভাত জোটে না সে কেন সাহিত্য নিয়ে মেতে আছে?”। আর এই সব কটাক্ষকে উপেক্ষা করেই তাঁর এগিয়ে চলা।

যৌথ পরিবারে বিশ্বাসী পিন্টু বাবুর বাড়িতে আছেন মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, দাদা-বৌদি, ভাইপো-ভাইঝি। লকডাউনের সময় দিনে ৫০-৬০ টাকা আয় হত। এখন তা বাড়লেও খুবই অল্প টাকা রোজগার তাঁর। সেই টাকায় সংসার চালিয়েও ভেঙে পড়েননি তিনি। পিন্টু বাবুর কথায়, “এই যে চারিদিকের পতন, ভেঙে যাচ্ছে, কিচ্ছু হচ্ছে না!

এইসব ক্ষেত্রে না কেঁদে, অন্যকে দোষারোপ না করে নিজের দৃষ্টান্ত স্থাপনে আমি খুব বিশ্বাসী। সেই জন্য আমি যতটা পারি সবাইকে নিয়ে থাকার চেষ্টা করি। যাতে আমার জীবনটা দেখে সকলে কিছু শিখতে পারে”। তাঁর লেখা ‘পারুল মাসীর ছাগলছানা’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’, ‘ইলিশখেকো ভূত’, ‘কচুরিপানার ভেলা’ ও ‘ঝিনুক কুমার’ এই পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বহু প্রথম সারির পত্রিকাতেও তাঁর লেখা প্রকাশ পেয়েছে।

অবহেলা-অপমান সহ্য করেও নিজের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চোখে এখনও অনেক স্বপ্নের ভিড়। তবে এত দারিদ্রতার মধ্যেও তিনি কখনও হারিয়ে ফেলেননি নিজের মনুষ্যত্ব! এমন মানুষকে আজও কেউ চেনে না। তবে চিনবে একদিন, এমন আশাতেই অনবরত সৃষ্টি করে চলেছেন নতুন নতুন লেখা। পিন্টু বাবু মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো একটা কথা বললেন, “দুনিয়ার চারিদিকে এত দুঃখ কষ্ট যে নিজের দুঃখ কষ্টগুলো পাশে রেখে আমাদের লিখতে হয়। কারণ অন্যদের দুঃখের কাছে নিজের দুঃখ অনেক কম।”