দেশে ভেনামি চিংড়িতে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের

বাংলাদেশের আটটি প্রতিষ্ঠানকে ভেনামি চিংড়ি পরীক্ষামূলক চাষের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যদিও চিংড়ি চাষিরা বলছেন, এরই মধ্যে দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা তারা করেছেন, তাই এখন দরকার বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি।

চিংড়ি চাষ নিয়ে নানা ধরণের গবেষণার কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনার লোনাপানি কেন্দ্র বলছে, এরই মধ্যে এক দফায় একটি পাইলট প্রজেক্ট সেখানে শেষ হয়েছে এবং দ্বিতীয় দফায় পরীক্ষামূলকভাবে পোনা আবার ছাড়া হয়েছে।

লোনাপানি কেন্দ্রের কেন্দ্র প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ লতিফুল ইসলাম বলেন, এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে তারা এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন এবং তখনি জানানো হবে যে, বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা কেমন কিংবা এ চিংড়ি চাষের ভালো-মন্দ কেমন হবে।

তবে চাষিরা বলছেন, এটি নিয়ে আর নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু নেই বরং এখন দরকার বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন। বিশ্বে প্রায় সাড়ে চারশো প্রজাতির চিংড়ি আছে এবং বাংলাদেশেই আছে প্রায় সাতাশটি প্রজাতি। তবে বাগদা, চাকা, হরিণা ও গলদাই বাংলাদেশে বেশি চাষ হয়।

দুই হাজার তের-চৌদ্দ সালে যেখানে ৪১ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি রফতানি হয়েছে, সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে রফতানি হয়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার মেট্রিক টন।

অন্যদিকে, অর্থের হিসেবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যেখানে প্রায় ৪৫ কোটি ডলারের চিংড়ি রফতানি হয়েছে সেখানে করোনার সময়ে রফতানি আরো কিছুটা কমলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রফতানি কিছুটা বেড়েছে।

চাষিরা বলছেন, বাগদা আর গলদা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান ঠিক রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে কারণেই তারা মনে করেন দ্রুত ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষের অনুমতি দেয়া দরকার।

কোথা থেকে এলো ভেনামি চিংড়ি : বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় চিংড়ি চাষি সাতক্ষীরা বিসমিল্লাহ হ্যাচারির মালিক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ভেনামি চিংড়ি ব্রাজিল থেকে আসা দক্ষিণ আমেরিকান চিংড়ির একটি প্রজাতি। বিশ্বে এখন যত চিংড়ি চাষ হচ্ছে তার ৭৯ ভাগ হলো ভেনামি চিংড়ি।

একই সঙ্গে এশিয়ার দেশগুলোতে এখন যত চিংড়ি চাষ হচ্ছে তার আশি ভাগই ভেনামি। বিশেষ করে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ভারতসহ এশিয়ার ষোলটি দেশে এ প্রজাতির চিংড়ির চাষ হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া চিংড়ির ৮৫ শতাংশ যায় ইউরোপের দেশগুলোতে। পনের শতাংশ যায় আমেরিকা, জাপানসহ অন্যান্য দেশে। তবে এসব দেশে বাগদা বা গলদার আর আগের মতো চাহিদা নেই। আবার দামের দিক থেকেই বাগদার চেয়ে ভেনামির দাম অন্তত দুই ডলার বেশি।

চাষি সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ভাইরাসের কারণে বাগদা চাষ অলাভজনক হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। আগে থেকেই আমরা বিকল্প খুঁজছিলাম। দুই হাজার চার সালে যৌথভাবে থাই উদ্যোক্তাদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে যাই ভেনামি দেখে।

তিনি বলছেন, বিশ্বে চিংড়ির বড় যে মেলা হয় ব্রাসেলসে সেখানে এখন ক্রেতারা দশ কনটেইনার চিংড়ির অর্ডার দিলে আট কন্টেইনারই চায় ভেনামির।

ভেনামির জন্য চাষিদের প্রস্তুতি কেমন : সরকার এখন যে আটটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলক ভেনামি চাষের অনুমতি দিয়েছে তার একটি হলো এম এ হাসান পান্নার মালিকানাধীন প্রান্তি গ্রুপ। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ইনটেনসিভ শ্রিম্প কালচার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মিস্টার হাসান বলেন, ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন দিলে সেটি শুধু চিংড়ি নয় বরং দেশের অর্থনীতিকেই পাল্টে দেবে।

তিনি আরো বলেন, অনুমোদন পাওয়ায় এখন তার প্রতিষ্ঠান থাইল্যান্ড থেকে পোনা এনে নিজস্ব হ্যাচারিতে চাষের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ চিংড়ির চাষ হয় আধুনিক পদ্ধতিতে। বায়ো সিকিউরিটি মেনটেইন করতে হয় এবং দরকার হয় নোনা পানির। যদিও বিদেশে এখন মিষ্টি পানিতেও এর চাষ হচ্ছে। আমরা দরকারি অবকাঠামো ঠিক করেছি। তবে দ্রুত এর বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন দিয়ে রফতানি বাজার ঠিক রাখা দরকার।

প্রচলিত চিংড়ির সঙ্গে ভেনামির পার্থক্য কী : বরিশালের স্কুল শিক্ষিকা নাসিমা আক্তার চিংড়ি খুব পছন্দ করেন। তার মতে, চিংড়িতে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় এ খবরে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও চিংড়ি বাদ দেননি খাবার তালিকা থেকে।

তিনি জানান, এখন নতুন প্রজাতি এলেও চাষি ও ব্যবসায়ীরা যেন সততার সঙ্গে সেটি চাষ করেন সেটিই হবে আমার চাওয়া। কারণ অতিথি এলেও তিনি খাবার তালিকায় চিংড়ি রাখতে পছন্দ করেন। একই ধরনের কথা বলেছেন আশুলিয়া এলাকার একজন গৃহিনী আফরোজা সুলতানাও। তিনি বলেন, চিংড়ি ভীষণ মজার।

কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে উৎপাদিত গলদা বা বাগদা চিংড়ি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিলো আগেই যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় সরকার ও চাষিদের।

চাষি সিরাজুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাগদা চিংড়ি চাষ করলে যেখানে প্রতি হেক্টরে ৩৮০ কেজি মাছ পাওয়া যায় সেখানে পাইকগাছায় লোনাপানি কেন্দ্রের পরীক্ষায় প্রতি হেক্টরে ভেনামির উৎপাদন হয়েছে ৯/১০ হাজার কেজি।

অন্যদিকে এম এ হাসান পান্না বলছেন, ভেনামি যেখানে একর প্রতি নয় দশ টন উৎপাদন হয় সেখানে বাগদা পাওয়া যায় দুই হাজার কেজি। আর গলদার পরিমাণ আরো কম। তিনি আরো বলেন, ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি সাধারণত ৩০/৪০ টায় এক কেজি হলেই বাজারজাত করা হয় এবং এই সাইজের চাহিদাই বিশ্বব্যাপী বেশি।