গোপাল ভাঁড় কি সত্যিই ছিলেন? নামটিকে আপনার কখনও দূরের মনে হবে না, অচেনাও মনে হবে না। বরং কাউকে ভোলোভাবে খোঁচা দেওয়ার জন্য এই চরিত্রটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য, যুগ যুগ ধরে গোপালের কীর্তি মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। নিজেকে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর বলে পরিচয় দেওয়া নগেন্দ্রনাথ দাসের একটি বই রয়েছে ‘নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়’ নামে। সেটাকে প্রামাণ্য জীবনী ধরলে মানতেই হবে গোপাল সত্যিই ছিলেন। কিন্তু এর সত্যতা মিলেও যেন মেলে না।
গোপাল যে ছিলেন এই পক্ষের যুক্তিতে পাওয়া যায়, ১৯২৬ সালে প্রকাশিত নগেন্দ্রনাথের বইটি থেকে। বইয়ের প্রকাশক তিনি নিজেই। ছেপেছিল কুন্তলীন প্রেস। লেখকের দাবি করেন, গোপাল ভাঁড়ের আসল নাম গোপালচন্দ্র নাই। যার অর্থ এই যে, বংশগত ভাবে তিনি ছিলেন নাপিত। কিন্তু ছুরি-কাঁচি হাতে তুলে নেননি গোপাল। তিনি ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক তত্ত্বাবধায়ক। সেই ভাণ্ডার থেকেই ভাণ্ড তথা ভাঁড়। গোপালের বাবা দুলালচন্দ্রও নাপিতের কাজ করতেন না। তিনি ছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁর বৈদ্য।
সেই যুগে শল্যচিকিৎসার কাজও অনেক সময় নাপিতরাই করতেন। তার বড় ছেলে কল্যাণ দুলাল সিরাজউদ্দৌল্লাকে বাল্যকালে কঠিন অসুখ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। আর ছোট ছেলে হলেন আমাদের প্রিয় ও চিরচেনা গোপাল। যিনি ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব বুদ্ধিমান। লোকমুখে তার বুদ্ধিদীপ্ত মজার কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জানতে পারেন গোপালের কথা, তিনি তাকে নিজ সভায় স্থান করে দেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে পঞ্চরত্নসভার অন্যতম রত্ন গোপালের এক তৈলচিত্রও রয়েছে। এমনই সব দাবি রয়েছে গোপালের অস্তিত্বের সপক্ষে।
কিংবদন্তি ভাষাবিদ ও ঐতিহাসিক সুকুমার সেন বলছেন, ‘গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতূহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি জাতীয় ঐতিহ্য গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে তার বীজ হচ্ছে ভাঁড় নামের অংশটি, গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড়টুকু সংস্কৃত শব্দ ভাণ্ডারের ‘ভাণ্ড’-জাত মনে করে অনেক গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন। পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তি যাই হোক, গোপাল ভাঁড় বাঙালি রসিক ও লৌকিক সংস্কৃতিতে অমলিন হয়ে আছেন।’
এই যুক্তি প্রমাণ করে যে ‘বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যক্তি’ শব্দবন্ধটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিমল গোস্বামীর লেখাতেও পরিষ্কার দাবি করা হয়েছে, গোপালের অস্তিত্ব গবেষকরা খুঁজে পাননি।
গোপালের জন্মসাল কিংবা কোথায় তিনি জন্মেছিলেন তা কোনও নথিতে পাওয়া যায় না। এমনকি তার বাড়ির দলিল-দস্তাবেজেরও কোনো খোঁজ মেলে না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় ছিলেন কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর । তিনি এত কিছু লিখেছেন, কিন্তু তার রচনায় গোপালকে নিয়ে কিছুই নেই। আবার সভায় ছিলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন। এই কিংবদন্তিও কোথাও গোপালকে নিয়ে কিছু লিখেছেন বলে জানা যায় না।
১৯৫৩ সালের বাংলা ছবি ‘গোপাল ভাঁড়। সেই সময় প্রতিটা ছবির সঙ্গে বুকলেট দেওয়া হত। এর সঙ্গে পাওয়া যেত গানগুলোও। বৈষ্ণব আজু গোঁসাই গোপালকে খোঁচা দিচ্ছেন, ‘কৃষ্ণচন্দ্রের অশেষ দয়া তাই খাচ্ছ সুখে দুধকলা/ ছত্রছায়া সরে গেলে খাবে শুধু কাঁচকলা।’ এই গানের লাইনগুলো লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য।
সেই সমাজ এক সাধারণ মানুষকে রাজার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠাকে কোন চোখে দেখছে সেটাই এখানে বুঝিয়েছেন তিনি। যা পড়তে গিয়ে মনে হয়, কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে গোপালের বেশি গুরুত্ব পাওয়াতেই ভারতচন্দ্র হিংসার বশবর্তী হয়ে কিছু লেখেননি- হতে পারে এমনটাও।
গোপাল থাকুক বা না থাকুক, তার নামে প্রচলিত বুদ্ধিদীপ্ত গল্পগুলোই হারাতে দেবে না এই নাম।