প্রায় চারশো বছর পাল শাসনের অধীনে ছিল বাংলা। আট শতকের মাঝামাঝি সময়ে গোপাল পালের মাধ্যমে বাংলায় পাল শাসন শুরু হয়। এই রাজবংশের আঠারো জন রাজার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলায় উত্থান-পতন লক্ষ করা গেছে। তারপরেও প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে পাল শাসন যে একটা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
পাল রাজাদের ইতিহাস (আ. ৭৮১- ১০৪২ খ্রি) উত্থান, পতন, অবক্ষয় ও গৌরবের ইতিহাস।
পাল বংশের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার যুগ ছিল ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনকাল। এ সময়ে পাল রাজারা উত্তর ভারতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। উত্তর ভারতে প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য তারা পশ্চিম ভারতের গুর্জর-প্রতিহার এবং দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে এক ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে লিপ্ত হন।
পাল আমলের তাম্রলিপিবাংলায় যখন পাল বংশের উত্থান ঘটে দক্ষিণ ভারতে তখন রাষ্ট্রকূটরা চালুক্যদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। গুর্জর-প্রতিহারগণ (জাতিগত যাযাবর) মালব ও রাজস্থানে নিজেদের শক্তি সুদৃঢ় করে। সেসময় উত্তর ভারতে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় যশোবর্মন ও ললিতাদিত্যের ঝটিকা আক্রমণে। তার পরবর্তী দুইপুরুষ ধরে কনৌজকেন্দ্রিক উত্তর ভারতের শূন্যতা পূরণে অভিলাষী এ তিন শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
ধর্মপালের শাসনামলে দুটি পর্যায়ে এ ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধ চলমান ছিল। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বিপর্যয় দেখা দিলেও প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি কিছু সাফল্য লাভ করেন। ধর্মপাল কনৌজ পর্যন্ত নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। সে সময় নিজের তার অনুগত চক্রায়ুধকে কিছুকালের জন্য সেখানকার সিংহাসনে বসান।
বাংলা ও বিহারের বাইরে কনৌজ পর্যন্ত পাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন ধর্মপাল। অন্যান্য দিকেও হয়ত তিনি তার রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেছিলেন। কিন্তু তার সাফল্যের পরিমাণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে ধর্মপাল বিপর্যয়ে পড়েন। তারপরেও তিনি বাংলা ও বিহারের বাইরেও স্বীয় প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পাল বংশের ইতিহাসে ধর্মপালের নাম একজন বিখ্যাত বিজেতা হিসেবে পরিচিত এবং উল্লিখিত। তার নেতৃত্বে উত্তর ভারতে বাংলার কর্তৃত্ব বেশ কিছুকাল ধরে অব্যাহত থাকে।
ধর্মপাল ছিলেন একনিষ্ঠ বৌদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার খ্যাতি আছে। বিক্রমশীলা বৌদ্ধবিহার তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। নয় থেকে বারো শতক পর্যন্ত এটি ছিল সমগ্র ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। পাহাড়পুর এর (বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায়) সোমপুর মহাবিহার ধর্মপালের অপর একটি বিশাল স্থাপত্য কর্ম।
ধর্মপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী দেবপালও পিতার নীতি অব্যাহত রাখেন। উত্তর ভারতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তার সময়েও অব্যাহত থাকে। তিনি হয়ত প্রাথমিক কিছু সাফল্য লাভ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুর্জর-প্রতিহারগণ কনৌজ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়। তবে পাল সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং উত্তর-পূর্বে কামরূপ এর দিকে বিস্তার লাভ করে।
ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনামল পাল সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তির যুগ। এ দুজন শাসক বাংলার দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল এবং বিহারে পাল সাম্রাজ্য সংহত করেন। তাদের আমলে প্রথমবারের মতো বাংলা উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে বাংলা মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কিন্তু দেবপালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এ গৌরবময় যুগের অবসান ঘটে এবং শুরু হয় স্থবিরতার যুগ। এ স্থবিরতা ক্রমশ পাল সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়।
পাল সাম্রাজ্যের স্থবিরতা পাঁচজন রাজার শাসনামলব্যাপী একশত বছরেরও অধিককাল ধরে চলে। ধর্মপাল ও দেবপালের আমলে যে শৌর্যবীর্য ও শক্তির প্রকাশ ঘটে, এ আমলে ঘটে না। এ সময় সাম্রাজ্য বিস্তারের আদৌ কোনো চেষ্টা করা হয়নি। বৈদেশিক হামলা এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার শক্তিও পাল রাজাদের ছিল না। দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কম্বোজগণ পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অংশবিশেষে অনেকটা স্বাধীন হয়ে ওঠে। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্য শুধু বিহারের অংশবিশেষে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। শিলালিপি থেকে কম্বোজ গৌড়পতিদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়।
Priyo Bangla 24 – Most Popular Bangla News The Fastest Growing Bangla News Portal Titled Priyo Bangla 24 Offers To Know Latest National And Local Stories.