যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করতে বলেছিলো ভারত। বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট এমনই এক তথ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর চাপ প্রয়োগ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছিলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছর আগে থেকেই ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের কাছে লবিং শুরু করেন।
বৃহস্পতিবার মার্কিন ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকায় শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ ইস্যুতে শিথিলতা প্রদর্শন করার জন্য চাপ দিয়েছিলো ভারত।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মার্কিন কূটনীতিকরা এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের এবং সমালোচকদের গ্রেফতার করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন। বাইডেন প্রশাসন বিচারবহির্ভূত অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দেয়।
এ পরিস্থিতির পর ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে বাংলাদেশ বিষয়ে গণতন্ত্রপন্থী মন্তব্য কমানোর দাবি জানান। ভারতীয় কর্মকর্তাদের যুক্তি ছিলো, বিরোধী দলকে উন্মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ দিলে বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এবং সেখানে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে পারে।
ভারত সরকারের একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘আপনি এটাকে গণতন্ত্রের মানদণ্ডে বিচার করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরা আমেরিকার সঙ্গে বহুবার কথা বলেছি এবং বলেছি, এটি আমাদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। কৌশলগত ঐক্যমতের অভাবে আপনি আমাদের কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন না।’
ভারতের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশ ইস্যুতে সমালোচনা কমিয়ে দেয় এবং শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে পরবর্তী নিষেধাজ্ঞার হুমকি স্থগিত করে, যা বাংলাদেশের অনেকের জন্য হতাশাজনক ছিলো।
মার্কিন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সবসময় ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। অনেক জায়গায় পরিস্থিতি জটিল এবং অংশীদারদের সঙ্গে এমনভাবে কাজ করতে হয়, যা সব সময় মার্কিন জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে মেলে না।
জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে তা নিয়ে মার্কিন সরকারের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেন। তবে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা মনে করতেন, শেখ হাসিনাকে বিচ্ছিন্ন করা খুব একটা লাভজনক হবে না।
ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার নেতিবাচক দিকও বিবেচনা করা হয়েছিলো। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নভেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে বৈঠক করেন, যেখানে এ বিষয়টি আলোচনা হয়। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও ওয়াশিংটন সফরকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, সবসময় উভয় দেশের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বাস্তবতাও বুঝি। বাংলাদেশে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং সেখানে অনেক স্বার্থ জড়িত।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর হস্তক্ষেপকারী ও কট্টর জাতীয়তাবাদী দেশ হিসেবে দেখা হয়।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ অব মিশন জন ড্যানিলোভিজ মন্তব্য করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে এ অঞ্চলে নিজেদের স্বার্থের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা করা ভুল ছিলো। তিনি আরও বলেন, নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনকে নমনীয়তা দেখাতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে, তারা বাংলাদেশের জনগণ ও তাদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পাশে না থেকে ভুল করেছে।