ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পর থেকেই সতর্ক বিএনপি। সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘটিত সহিংস কর্মকাণ্ড, দখলবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হুমকি-ধমকিসহ যে কোনো ধরনের অপকর্ম রোধে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কঠোর বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, কোনোরকমের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সহিংসতা বরদাশ্ত করা হবে না। বিএনপিতে কোনোরকমের সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই হবে না। বরং কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। এদিকে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকা ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলো ব্যবস্থা নিচ্ছে। দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের নেতাকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। গতকাল বিকালেও দীর্ঘদিন ভারতে নির্বাসিত থেকে সদ্য দেশে প্রত্যাগত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনকেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে কারণ দর্শানো নোটিস পাঠানো হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের নোটিসের জবাব দিতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ধারাবাহিক বিভাগীয় মতবিনিময় সভাগুলোয় প্রধান অতিথির (ভার্চুয়াল) বক্তৃতায় একই বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির হাইকমান্ড তারেক রহমান। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলছেন, বিএনপিতে কোনো দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই হবে না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। ইনসাফ আর ভালোবাসা দিয়ে মানুষের মন জয় করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ারও নির্দেশনা দিয়ে তারেক রহমান বলেছেন, দলের নাম ভাঙিয়ে কিছু দুষ্কৃতকারী দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় লিপ্ত। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। তাঁর এসব নির্দেশনা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। দেশব্যাপী নৈরাজ্য প্রতিরোধ করে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে তৎপরতা চালাচ্ছেন তারা। জনগণের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা অর্জন করতে কাজ করছেন। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ২৮ দিনে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ২ শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) ও পদ স্থগিত করা হয়েছে শতাধিক নেতা-কর্মীর। এ তালিকায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। দলের অন্যতম নেতা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে পদাবনত করে উপদেষ্টা থেকে নির্বাহী সদস্য করা হয়েছে। ফরিদপুরের নগরকান্দায় আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষের ঘটনায় একজন নিহত হওয়ার পর বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের পদ স্থগিত করা হয়েছে। দলের কান্ডারি তারেক রহমানের কড়া নির্দেশ অনুযায়ী শৃঙ্খলা রক্ষায় জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে বিএনপি। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। গির্জা, মন্দির, প্যাগোডার নিরাপত্তা দিন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাস দিয়ে মানুষকে মাপা যাবে না। একজন ব্যক্তির পরিচয় তিনি মানুষ। আপনার পাড়া-প্রতিবেশী যেখানেই কেউ এমন কিছু করার চেষ্টা করবে ভুক্তভোগীর বন্ধু হিসেবে তার নিরাপত্তায় আপনি ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের ভূখে বসবাসকারী সবার একটিই পরিচয়-আমরা বাংলাদেশি। নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, পরাজিত অপশক্তির পাতা ফাঁদে কেউ পা দেবেন না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চূড়ান্ত সফলতায় নিতে হলে কেউ দখলদারিতে লিপ্ত হবেন না, দখলদারিতে সহায়তা করবেন না। কেউ আইন নিজেদের হাতে তুলে নেবেন না।
এদিকে নানা অপকর্মে জড়িতরা বেশির ভাগই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দাবি বিএনপি নেতা-কর্মীদের। তাদের মতে, এরা দলের কোনো পদপদবিতে নেই। অতীতে ছিল না দলীয় কোনো কর্মসূচিতে। আন্দোলন-সংগ্রামেও দেখা যায়নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারাই এখন বিএনপির ‘নেতা-কর্মী’ সেজে গেছে। দাপট দেখাতে শুরু করেছে নিজ নিজ এলাকায়। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দখল, চাঁদাবাজি আর অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। এ পরিস্থিতিতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ কথিত নেতা-কর্মীর বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তও রয়েছে দলের। পাড়ামহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাজধানীসহ কয়েকটি জেলায় দখল করা বাড়ি, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিককে বুঝিয়ে দিয়েছেন এমন ঘটনাও অনেক রয়েছে। মানিকগঞ্জে বিএনপি নেতারা পরিবহন সেক্টরকে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসমুক্ত করেছেন। জানা গেছে, গত তিন সপ্তাহে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের ২ শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যুবদলের প্রায় ৮০, ছাত্রদলের ২০, বিএনপির ৬০ ও স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য সংগঠনের আরও বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। এ ছাড়া সাত জেলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। শাস্তি পাওয়া নেতাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেন ঢাকা মহানগর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার। ছাড় দেওয়া হচ্ছে না কেন্দ্রীয় নেতাদেরও। বিএনপির বরিশাল বিভাগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে। শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হাশিমকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে সোমবার চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এস এম মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এসব বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে মানুষের আশা ও প্রত্যাশা পূরণের জন্য যেমন নতুন রাজনৈতিক পরিকল্পনা দরকার, তেমন তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাংগঠনিক পরিকল্পনাও প্রয়োজন। চলমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপি এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ও সতর্ক। তার প্রমাণ দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। রাজধানীর আদাবর থানা বিএনপির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আলোচিত-সমালোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর জায়গায় বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে একটি মহল দখলের চেষ্টা করে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নজরে আসার পর তাঁর নির্দেশে তাৎক্ষণিক ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হকের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা সেখানে গিয়ে খালের জায়গায় গড়ে তোলা রাজনৈতিক কার্যালয়টি দেখে তা ভেঙে ফেলেন। উদ্ধার করেন খালের সরকারি জায়গা। যে কোনো অনিয়মের বিষয়ে দলের অবস্থান প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, দেশের অনিয়ম দূর করতে আন্দোলন করেছি। দলের কেউ যদি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকে তা বরদাশত করা হবে না। তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপিতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, বিএনপিতে কোনো দুষ্কৃতকারীর ঠাঁই নেই। তবে বিএনপির নাম ব্যবহার করে পতিত আওয়ামী লীগের কোনো কোনো ব্যক্তি নানা অপকর্ম করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ আসছে। সেজন্য দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এরই মধ্যে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ ও খায়রুল কবীর খোকনকে শোকজ : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালা-উদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবীর খোকনকে শোকজ করেছে দলটি। গতকাল বিকালে বিএনপির দপ্তরের এক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সূত্র জানান, চট্টগ্রামে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের গাড়ি ব্যবহারের জন্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে এবং নরসিংদীতে দখলবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে খায়রুল কবীর খোকনকে শোকজ করা হয়েছে। শোকজ নোটিসে আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে।