বড্ড টানাপোড়নের সংসার আব্দুল মতিনের। অভাবের সংসারে তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে মোতালেব বড় ছিল। স্কুল পড়ুয়া ছেলে স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ারও ছিল বাবার। স্বপ্ন ছিল মোতালেব পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিবারের হাল ধরবে।
কিন্তু গত ৪ আগস্ট রাজধানীর জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল মোতালেব (১৪) এবং চিরতরে ভঙ্গ হয়ে যায় পরিবারের স্বপ্ন।
মোতালেব ছিলেন হাজারীবাগের গজমহল লেনের বাসিন্দা এবং তার পরিবার ২০১৭ সালে নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। মোতালেবের বাবা আব্দুল মতিন তার ছেলেকে শিক্ষিত করে সংসারের হাল ধরার স্বপ্ন দেখতেন। তবে সেই স্বপ্ন চিরতরে ভেঙে যায় পুলিশের গুলিতে মোতালেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
মোতালেবের মা জাহানারা বেগম, এখনও সেই বিভীষিকাময় দিনটি ভুলতে পারছেন না। তিনি জানান, সারাদিন ছেলেকে ঘর থেকে বের হতে দেইনি, বিকালে আমি বাজারে ডাল কিনতে গিয়ে, ফিরে এসে দেখি আমার ছেলে বাসায় নেই। পরে সন্ধ্যার দিকে এক বন্ধুর মাধ্যমে ছেলের রক্তাক্ত ছবি দেখে শিকদার মেডিকেলে ছুটে যাই। কিন্তু ওখানেও ওকে পাইনি। পরে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে ছেলের লাশ প্রথমে চিনতে পারিনি, পরে শনাক্ত করতে পেরেছি।
জাহানারা বেগম জানান, এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না, ছেলেকে স্বপ্নে দেখি। আমার বড় পুত আন্দোলনে ওর সহপাঠীদের বলেছিল, আমি মারা গেলে, লাশটা আমার মায়ের কাছে পৌঁছে দিও।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলে ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। মাঝেমধ্যে বলতো, ‘মা, আমার বড় ভাইদের মেরে ফেলছে, কেউ কিছু করছে না। আমি থাকতে পারলে ভালো হতো।’
মোতালেবের মা বলেন, আমার ছেলে দেশের জন্য শহিদ হয়েছে, তার যে কতটুকু দেশপ্রেম ছিল, তা এখন বুঝতে পারি।
মোতালেবের বাবা আব্দুল মতিন জানান, সেদিন আমি সকালে কাজে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় শুনি আমার ছেলে গুলি খেয়েছে। পরে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে ভোটার আইডি কার্ড দেখিয়ে আমার ছেলের লাশ শনাক্ত করি এবং বাসায় নিয়ে যাই। আমার ছেলেকে মানুষ করতে চেয়েছিলাম, সংসারের একমাত্র ভরসা ছিল সে। এখনো ঠিকমতো কাজে যেতে পারি না। সব সময় ওর চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে।
মোতালেবের শিক্ষক নূর জামাল হক, মোতালেব আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। তার ভাষ্যমতে, গত ৪ আগস্টের দিনটি ছিল ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা ধানমন্ডি ৩ নম্বরের আওয়ামী লীগ অফিস থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায়। মোতালেব তখন পার্টি অফিসের অপর পাশে অবস্থান করছিল। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে তার বুকে গুলি লাগে এবং সহপাঠীরা তাকে শিকদার মেডিকেলে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোতালেবের মৃত্যু তার পরিবারকে গভীর শোকের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পরিবারের সদস্যরা প্রতিনিয়ত হারানো ছেলের স্মৃতিতে ভেঙে পড়ছেন। এখনো কেউ তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। মোতালেবের অকাল মৃত্যুর মাধ্যমে একটি সম্ভাবনাময় জীবন শেষ হয়ে গেল, যা তার পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।