গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা এক প্লেট ভুনা খিচুড়ি, দাম ৮০ টাকা।
হোটেল-রেস্তোরাঁয় যেখানে ছোট ছোট কয়েক টুকরোর এক প্লেট মাংস বিক্রি করা হয় ১৫০ টাকায় আর হাট-বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম পড়ে ৬৫০ টাকা।
সেখানে মাত্র ৮০ টাকায় ঈশ্বরদীর ‘কিছুক্ষণ’ হোটেলে মিলছে সুস্বাদু বিফ খিচুড়ি।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে দফতরের সামনে রেলওয়ে ফুটবল মাঠ সংলগ্ন আমতলা মাঠে শত বছরের কড়ই তলার এ হোটেলটিতে প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরে থাকে বিফ খিচুড়ির আয়োজন।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে আওতায় থাকা দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন কেউ নেই, যার পদধূলি এ হোটেলে পড়েনি। রেলওয়ের ঠিকাদাররাও দুপুরে এখানেই খাওয়া-দাওয়া করেন।
ষাটোর্ধ্ব আতিয়ার রহমান হোটেলটির মালিক। প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় কোনো দিন পা রাখার সৌভাগ্য হয়নি আতিয়ারের। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক অভাবের সংসার ছিল বলে শিশুকালেই হোটেল শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে তাকে। তখন থেকে রান্না শিখে নেন তিনি। আশির দশকে পাকশীতে গড়ে ওঠে বিভাগীয় রেলওয়ের সদর দফতর। তখন কষ্টার্জিত আয়ের মাত্র ৭৫ টাকা নিয়ে হোটেল ব্যবসায় আসেন আতিয়ার।
দেশের বিভিন্ন জেলার রেল কর্মচারী ও আশেপাশের সবাই তাকে ‘আতি ভাই’ ডাকেন। ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নে সিবিলহাট তালতলা এলাকার মৃত আফসার আলী সরদারের বড় ছেলে তিনি।
প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্তই হোটেলটি চালু থাকে। খাবার শেষ হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় হোটেলটি। সেই অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে ‘হোটেল কিছুক্ষণ’।
পাকশীতে রয়েছে নৈসর্গিক মনোরম দৃশ্য। শত বছরের কড়ই গাছ দেখার জন্য দেশের দূর দুরান্তর থেকে স্বপরিবারে অনেকেই আসেন। অনেকে ঘরোয়া পরিবেশে রান্না করা খাবার খেয়ে চলে যান। বর্তমানে ঈশ্বরদীর পাকশীতে গড়ে উঠেছে ইপিজেড ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। সেই সুবাদে অনেক শ্রমিকও বৃহস্পতিবার বিফ খিচুড়ি খেতে ছুটে আসেন ‘হোটেল কিছুক্ষণে’।
পাকশী সদর দফতরের পাশে রেলওয়ের জমি লিজ নিয়ে হোটেল কিছুক্ষণ নির্মিত, ওপরে টিনের চালা, ইট-বালু দিয়ে কোনো মতে দাঁড় করানো দেয়াল। কাঠের পাল্লাযুক্ত দরজা। খাওয়ার আগে এখানে হাত ধোয়ার জন্য কোনো বেসিনও নেই। বাইরে প্লাস্টিকের বালতিতে মগ দিয়ে পানি তুলে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হয়। ভেতরে আসবাবপত্র বলতে কয়েকটি কাঠের টেবিল চেয়ার। কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া না থাকলেও সবকিছুই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত এখানে মেলে বিফ খিচুড়ি। খিচুড়ি খেতে হলে আগে এসে অর্ডার করে যেতে হবে।
বৃহস্পতিবার ‘কিছুক্ষণ’ হোটেলের সামনে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে কোনো কর্মচারী নেই। আতিয়ার রহমান নিজেই রান্নার উপকরণ কেটে-বেছে খিচুড়ি রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর রান্না শেষ হতে না হতেই মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। কেউ হোটেলে বসেই সুস্বাদু ভুনা খিচুড়ি খাচ্ছেন। কেউ বা পরিবারের জন্য বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। দুপুর ২টা বাজতে না বাজতেই পাতিল ভর্তি খিচুড়ি শেষ!
পাকশী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদুজ্জামান টোকন বাংলানিউজকে বলেন, কিছুক্ষণ হোটেলের খিচুড়িসহ সব খাবারই সুস্বাদু। আমরা বাড়িতে যে ধরনের খাবার খেয়ে থাকি, অল্প দামে সে ধরনের খাবার মেলে এখানে।
দৈনিক প্রথম আলোর পাবনা অফিসের প্রতিনিধি সরোয়ার মোর্শেদ উল্লাস প্রায়ই পাবনা শহর থেকে ছুটে আসেন মোটরসাইকেল নিয়ে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ হোটেলের খিচুড়ি স্বাদ মুখে লেগে থাকে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে অফিসের কর্মচারী মাসুদ রানা বাংলানিউজকে জানান, এখানে তুলনামূলক কম দামে বাড়ির রান্নার মতো খাবার পাওয়া যায়। ফলে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া যায়। চাহিদা বেশি থাকায় দুপুর গড়ালেই আর এখানে খাবার থাকে না, শেষ হয়ে যায়।
হোটেলের মালিক আতিয়ার রহমান আতি বাংলানিউজকে বলেন, আমি প্রায় ৪২ বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ১৯৭৩ সালে পাকশী পদ্মা নদীর ওপর ফেরিঘাট ছিল। ছোটবেলা আমি হোটেল কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছি। আশির দশকের শুরুতে পাকশীতে বিভাগীয় রেলওয়ের সদর দফতর অফিস গড়ে ওঠে। তখন উত্তর-পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের যত জেলা আছে, রেলওয়ের কর্মচারীদের পাকশী আসতেই হতো। ওই সময় আমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে হোটেল ব্যবসা শুরু করি। এক সময় আমাকে একা ফেলে ব্যবসার হিসাব চুকিয়ে চলে যায় সে। লেখাপড়া জানতাম না বলে হিসাব তখন কিছু বুঝিনি।
কতদূর লেখাপড়া করেছেন, জানতে চাইলে তিনি মুচকি হেসে বলেন, কোন বিদ্যা নাই পেটে। একবার সরকার থেকে কাজের ফাঁকে শিক্ষা- কার্যক্রম ব্যবস্থা চালু হয়েছি। তখন ১৭ দিন পড়ালেখা করেছিলাম।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই মানুষটির। তবে তিনি তার সুস্বাদু রান্না খাইয়ে অসংখ্য মানুষের মনকে জয় করেছেন। দাম্পত্য জীবনে তার স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছেন। কষ্ট করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে ঈশ্বরদী ইপিজেডে চাকরি করেন। দিনে তিন/চার হাজার টাকার খাবার বিক্রি করেন। সব খরচ বাদ দিয়ে দিনে সাত/আটশ’ টাকা নিয়ে বাড়িতে ফেরেন আতিয়ার রহমান আতি।