ফরিদপুরের বাসিন্দা জনি মিয়া (আসল নাম নয়) গত সাত বছর ধরে সৌদি আরবে মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিমাসেই পরিবারের কাছে টাকা পাঠান। এজন্য জেদ্দার হামরার একটি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তা জমা দেন তিনি। এর দুই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় তার পরিবারের কাছে অর্থ পৌঁছে দেয়া হয়।
জনি বলেন, ব্যাংকে যাওয়া ঝামেলা, কাগজপত্র চায়। আবার আমার বউকে টাকা তুলতে বাজারের ব্যাংকে যেতে হয়। এর চেয়ে এভাবে পাঠালে সহজে বাড়ির লোকজন হাতে পায়। আবার এখন দোকান থেকে পাঠালে ব্যাংকের চেয়ে কয়েক হাজার টাকা বেশিও পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, সৌদিতে যে বাড়িতে আমি থাকি, সেখানে আরও ছয়জন বাংলাদেশি এবং চারজন ভারতীয় নাগরিক থাকেন। সবাই এভাবেই দেশে টাকা পাঠাই। জনি যে প্রক্রিয়ায় দেশে টাকা পাঠান, প্রচলিত ভাষায় তাকে হুন্ডি বলা হয়। আইনের দৃষ্টিতে যা অবৈধ অর্থ লেনদেন। তবে সেই বিষয়ে তার পরিষ্কার কোনও ধারণা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত আগস্টে প্রায় ১৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ ২০২২ সালের একই মাসে তা এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় আগস্টে প্রবাসী আয় কমেছে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশে ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। ঠিক সেসময়েই এমন সময়ে রেমিট্যান্স কমছে। এর আগে এপ্রিল ও মে’তে রেমিট্যান্স অনেক কমেছিল। তবে ঈদের মাস হওয়ায় জুনে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার এসেছিল। এরপর আবার কমতে শুরু করেছে।
হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোই দেশে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে মনে করছেন ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। যদিও এর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
এভাবে রেমিট্যান্স এলে সরকারি হিসাবে যোগ হয় না। বৈধ চ্যানেলের বাইরে প্রবাসীরা অর্থ দেশে পাঠিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করলেও আসলে ডলার, রিয়েল, দিনার বা রিঙ্গিত সেদেশেই থেকে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশি যে দেশে রয়েছে, তিনি সেদেশের মুদ্রায় পেমেন্ট করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশি টাকায় এদেশে তার স্বজনদের বিনিময় মূল্য দেয়া হয়।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী,গত বছর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে গিয়েছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিক। আগের বছর যা ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার। সব মিলিয়ে বিদেশে দেশের ২ কোটি ১১ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। এর বাইরে শিক্ষার্থী, অবৈধ কর্মী এবং অনিবাসী বাংলাদেশি মিলিয়ে অর্ধ কোটির মতো মানুষ বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। যাদের অধিকাংশই দেশে টাকা পাঠান।
প্রবাসী আয়ের ওপর ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তবুও রেমিট্যান্স আসার হার কমছে। এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাত এবং খোলাবাজারে ডলারের লেনদেনে বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে। বৈধ চ্যানেলে না এসে সেটা হুন্ডির কবলে পড়ে যাচ্ছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বিনিময় হার বেঁধে দিতে শুরু করেছে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফর এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) এবং ব্যাংকার্সদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। ডলারের অভিন্ন বিনিময় মূল্য নির্ধারর্ণ করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, এই দুটি সংগঠন যৌথভাবে ডলারের দর বেঁধে দেয়। সব ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই দরে লেনদেন করতে বাধ্য। অন্যথায় জরিমানার মুখোমুখি হবে।
এতে দেশের বাজারে আমদানির ক্ষেত্রে অভিন্ন ডলার পাওয়া গেলেও বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার প্রবণতা কমতে শুরু করে।
কারণ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী এলে ডলার প্রতি পাওয়া যাচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। সেটার সঙ্গে প্রণোদনার ২ শতাংশ যোগ করে বিনিময় মূল্য দাঁড়ায় ১১১ টাকা ৬৯ পয়সা। কিন্তু হুন্ডির মাধ্যমে বা খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেটে) ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা দরে। ফলে যারা আগে বৈধ চ্যানেল ব্যবহার করে টাকা পাঠাতেন, এমন অনেকে এখন হুন্ডির পথ বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খোলাবাজারেও মুদ্রাটির দাম বেড়েছে।
মালয়েশিয়ায় বসবাসরত রুবেল হোসেন বলেন, প্রতি মাসেই দেশে টাকা পাঠাতে হয়। আগে ব্যাংকের মাধ্যমেই পাঠাতাম। কিন্তু এখন বাইরে থেকে পাঠালে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি লাভ হয়। তাই এভাবে পাঠানো শুরু করেছি।
তিনি জানান, কুয়ালালামপুরে বেশ কিছু দোকান রয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে। সেখানে গিয়ে টাকা জমা দিলে দেশের স্বজনদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অথবা সরাসরি টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। ব্যাংকিং রেটের চেয়ে এভাবে পাঠালে টাকাও বেশি পাওয়া যায়। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেন বেআইনি হলেও প্রবাসী অনেকের সেই সম্পর্কে কোনও ধারনা নেই।
বাংলাদেশেও হুন্ডি ব্যবহার করে দেশে টাকা আনা বা দেশের বাইরে অর্থপাচারের অনেক অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝে মাঝে এর সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এখন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে। ঠিক এসময়েই কম রেমিট্যান্স আসার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। চলতি মাসেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের (আকু)দায় পরিশোধ করা হবে। এতে দেশে নিট রিজার্ভ ২২ বিলিয়নের নিচে নেমে যাবে। প্রতিমাসেই প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। নানা চেষ্টার পরেও সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বাড়াতে পারছে না। ব্যাংকিং খাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রেমিট্যান্স আসা গত কয়েক মাসে অনেক কমে গেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের সবাইকেই বেঁধে দেয়া দরে ডলার কিনতে হয় বা বিক্রি করতে হয়। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কার্ব মার্কেটে অনেক বেশি রেটে ডলার বিক্রি হচ্ছে। হুন্ডির কথা আর নাই বললাম। প্রবাসীরা হয়তো দেখছেন, তারা বাইরে বিক্রি করলে ভালো রেট পাচ্ছেন। তাই ব্যাংকে পাঠাচ্ছেন না। এটা ছাড়া রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার আর কোনও কারণ দেখছি না।
কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছেন, এখন যে রেমিট্যান্স আসছে, সেটার বড় অংশ আসে ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য উন্নত দেশ থেকে। কিন্তু সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, কুয়েত, মালয়েশিয়ার মতো যেসব দেশে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। যাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো বেশি প্রবাসী আয় পেয়ে থাকে। রাতারাতি সেখানকার রেমিট্যান্স কমে গেছে। যদিও সেখানকার শ্রমবাজারে বড় কোনও পরিবর্তন আসেনি। বরং প্রতিবছর কয়েক লাখ নতুন শ্রমিক যোগ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য মনে করছেন, বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া, সুদ হার বৃদ্ধির কারণেও প্রবাসীদের দেশে টাকা পাঠানোর প্রবণতা কিছুটা কমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, অভিন্ন ডলারের দর দেয়ার পরেও নিয়মিত চ্যানেলে ডলার আসছে না। কিন্তু মার্কিন মুদ্রার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। খোলাবাজারে ঠিকই ডলার চড়া মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এর মানে যেভাবে অভিন্ন দর ঠিক করা হচ্ছে। সেটার মধ্যে কোথাও একটা সমস্যা আছে। কিন্তু সেই সমস্যাটা শনাক্ত করার বা সমাধানের কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
রেমিট্যান্স কম আসার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর ব্যবসাতেও। যেসব ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন বেশি হয়, তাদের ডলার আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর প্রবণতা কমে যাওয়ায় এই খাত থেকে ব্যাংকগুলোর তা অর্জন কমে গেছে। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলছেন, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় আমাদের ব্যবসা মারাত্মকভাবে এফেক্টেড হচ্ছে। আমার পুরো ইমপোর্ট প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু আমি কিছু করতে পারছি না।
ডলারের বিনিময় মূল্য পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, অভিন্ন দর অব্যাহত থাকলে একসময় খোলাবাজারেও দাম নেমে আসবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো প্রবাসীরা ব্যাংকের বাইরে বেশি রেট পাচ্ছে। তারা হুন্ডি করে টাকা পাঠাচ্ছে। এটাও মুদ্রা পাচারের মধ্যে পড়ছে। কিন্তু তারা ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার না করে হুন্ডি ব্যবহার করছে। সেই কারণ শনাক্ত করতে হবে। আর সেটা সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় হলে সংকট আরও বেড়ে যাবে।
দেশের অর্থনীতিবিদরা একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন, ডলারের চাহিদা এবং জোগানের ভারসাম্য আনতে বিনিময় মূল্য বেঁধে না রেখে পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। সেটা করা হলে খোলাবাজারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক খাতের বিনিময় হারে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। তখন ডলার লেনদেন হুন্ডির প্রবণতা কমে যাবে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখেই সেই পথে হাঁটতে চায় না। কারণ তাতে টাকার মান আরও পড়ে যাবে বলে তাদের আশঙ্কা। এতে দেশের ভেতরে এর মধ্যেই রেকর্ড অবস্থায় থাকা মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। সূত্রঃ বিবিসি