‘নৌকার প্রার্থী হয়েছেন বলে চেয়ারম্যান হবেন, সেটা ভুলে যান’, সেই এএসপির আবেগঘন স্ট্যাটাস

নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতির বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. জুয়েল রানা। তারপরেই তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে বদলি করা হয়। দেয়া হয় বিভাগীয় মামলা। একের পর এক নিজ দপ্তর থেকেই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে থাকেন তিনি। তবে, এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আক্ষেপ প্রকাশ করে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলো তুলে ধরেছেন। জাতির কাছে চেয়েছেন ন্যায় বিচার এবং পুলিশের ব্যাপক সংস্কার। গত ১৮ আগস্ট রাতে তার একটি পোস্ট নতুন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

৩৪তম বিসিএসের পুলিশের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে (নৌ-পুলিশ) ঢাকায় কর্মরত আছেন। তার বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট এলাকায়।

গত ১৮ আগস্ট নিজের ফেসবুক পোস্টে আক্ষেপ প্রকাশ করে লিখেন, ‘অফিসারদের কীভাবে সম্মানিত করতে হয় তা সেনাবাহিনীর থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। মাত্র একজন ভদ্র মহিলার বাক্যবাণ সহ্য করে এই সেনা কর্মকর্তা আজ মহা সম্মানিত। অথচ লাখো লাখো মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করে, ভোট ডাকাতদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে পুলিশ, আর সরকারের কাছে আমি ছিলাম ভিলেন। আমার কপালে জুটলো স্ট্যান্ড রিলিজ, সিলেট এপিবিএন এ পোস্টিং, খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পোস্টিং, এরপর নদীতে (নৌ পুলিশে) পোস্টিং। ঘাড়ের উপর সকালে-বিকেলে গোয়েন্দা সংস্থা লোকের নিঃশ্বাস, জামায়াত-শিবির, বিএনপি, রাজাকার ট্যাগ, সঙ্গে বিভাগীয় মামলা। তদন্ত ছাড়াই বিভাগীয় মামলায় সাজা। আজ এর দরবারে ধর্না তো কাল ওর দরবারে ধর্না। জাতির ভোটের অধিকার রক্ষা করে আজ আমি সাজাপ্রাপ্ত অফিসার। আজও এই শাস্তির বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। জানি না এই বোঝা থেকে কবে মুক্তি পাবো। আমি জাতির কাছে ন্যায় বিচার চাই। আমার মত যেন কেউ আর বিপদগ্রস্ত না হয়। এজন্যই পুলিশের ব্যাপক সংস্কার চাই।’

জানা যায়, ২০২১ সালে কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মো. জুয়েল রানা। জেলার দাউদকান্দি ও চান্দিনা সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। চতুর্থ ধাপে অনুষ্ঠিতব্য কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটি ইউনিয়নের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো তাকে। ওই তিনটি ইউনিয়ন ছিল- কালিকাপুর, উজিরপুর ও কাশিনগর। ওই সময়ে কালিকাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় যোগ দেন তিনি। সেখানে নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ওই বক্তব্যের এক অংশে নির্বাচন সুষ্ঠু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জুয়েল রানা উপস্থিত প্রার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘নৌকার প্রার্থী হয়েছেন বলে চেয়ারম্যান হবেন সেটা ভুলে যান, ব্যালট ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলেই ডাইরেক্ট গুলি চলবে!’

ওই সভায় মো. জুয়েল রানার দেয়া ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সাহসী বক্তব্যের জন্য প্রশংসায় ভাসতে থাকেন তিনি। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই হঠাৎ পুলিশ দপ্তর থেকে তাকে বদলি করা হয়। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের সুশীল সমাজসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ একজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।

জুয়েল রানা আরও বলেছিলেন, ‘ব্যালটে হাত দেবেন তো গুলি করব। আমাদের প্রশিক্ষণ আছে, অর্ডার আছে এরপর কেউ কেন্দ্র দখল করতে আসলে আমরা কী ‘ফিডো’ খাব? গুলি করব, এতে যদি কারো হাত-পা পড়ে যায় আমাদের কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। অস্ত্র চালানোর একটা নিয়ম আছে, আগে অনুরোধ করব- না শুনলে গুলি করব। নির্বাচনের দিন আমি কালিকাপুর, উজিরপুর ও কাশিনগর এই তিনটি ইউনিয়েনের সরাসরি দায়িত্বে থাকব। আমি কথা দিচ্ছি এই তিনটি ইউনিয়নে দায়িত্ব পালনকালে কুমিল্লা থেকে কোনো মন্ত্রীও যদি আমাকে ফোন করে আমি কারো কথা শুনব না বরং কথা রেকর্ড করে আমি ছেড়ে দেব। সুতরাং এমপি, মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ, প্রধানমন্ত্রী কারো দোহাই দিয়ে আপনারা নির্বাচিত হতে পারবেন না। আমরা মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মানুষ যদি একজন রিকশাচালককেও নির্বাচিত করে সেই হবে ওই ইউনিয়েনের আগামী পাঁচ বছরের অভিভাবক। ইনশাল্লাহ জনগণের ভোটের অধিকার আমরা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই। এটা শুধু আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব না, এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্বও। এছাড়া নির্বাচনের ভোট সুষ্ঠু করা নিয়ে আরো বিভিন্ন কথা বলেছিলেন তিনি।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ পুলিশের ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্য জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছিলেন। অর্জন করেছিলেন শ্রেষ্ঠ সার্কেল এএসপি পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ জনবান্ধব কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও পুলিশের প্রথম অভিন্ন মানদণ্ডে পুরস্কার প্রদান শুরু হলে সেই মানদণ্ডেও চট্টগ্রা‌ম রেঞ্জের ১১ জেলার ৫০ জন সার্কেল অফিসারের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ সার্কেল অফিসার হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। অন্যায় যেন কেউ না করতে পারে সেই প্রতিবাদ করেছিলাম। তার জন্য আমাকে ভিলেন বানানো হয়েছিল, সাজা দেয়া হয়েছিল। আমি এই জাতির কাছে আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব ঘটনার ন্যায় বিচার চাই এবং পুলিশের ব্যাপক সংস্কার চাই।’