জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন শর্ত আরোপের সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুরুতর দুর্নীতি, অর্থ পাচার বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগিত ব্যক্তিরা প্রার্থী হতে পারবেন না। এমনকি এসব ব্যক্তি কোনো রাজনৈতিক দলের সাধারণ সদস্য বা নেতৃত্বে থাকার সুযোগও পাবেন না।
বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া কমিশনের প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়েছে। এতে সংবিধানের ৬৬(২)(ছ) অনুচ্ছেদের অধীনে একটি বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কাদের জন্য প্রার্থীতা নিষিদ্ধ?
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতন, দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধে অভিযুক্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। আদালতে চার্জশিট গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই তারা নির্বাচনের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, দুর্নীতি দমন কমিশন বা গুম কমিশন কর্তৃক অভিযুক্ত হলেও তাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মামলার অবস্থা
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুম-খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর জন্য শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং স্থানীয় আদালতগুলোতে মামলা হয়েছে। এসব মামলার চার্জশিট আদালত গ্রহণ করলেই অভিযুক্তরা নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।
নির্বাচনী সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে প্রতিবেদনে আরও উল্লেখযোগ্য কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে:
‘না’ ভোটের বিধান চালু: কোনো প্রার্থী ৪০% ভোট না পেলে পুনর্নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু হবে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নিষিদ্ধ: কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারবেন না।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার: অনলাইন ভোটিং এবং পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা।
একাধিক আসনে প্রার্থীতা বন্ধ: একজন ব্যক্তি একাধিক আসনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা: সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে কমিশনকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান।
ইভিএম বাতিল ও প্রতিরক্ষা বিভাগ অন্তর্ভুক্তি
ইভিএম ব্যবহারের বিধান বাতিল করে, নির্বাচনকালীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ
একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এছাড়া একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন।
উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব
সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসনের সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভোটের হারের ভিত্তিতে আসন বণ্টন এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সংসদ সদস্যদের সুবিধা কমানো
সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি, আবাসন সুবিধা, প্রটোকল এবং ভাতা পর্যালোচনা করে তা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংসদ সদস্যদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়নের সুপারিশও করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের বক্তব্য
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “গত কয়েকটি নির্বাচনে যারা নির্বাচনব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা প্রয়োজন। আমাদের লক্ষ্য ছিল একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং জবাবদিহিমূলক নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলা।”
তিনি আরও বলেন, “ইসির স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের ক্ষমতায়িত ও দায়বদ্ধ করার বিধান রাখার চেষ্টা করেছি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্র নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসবে। তবে এসব প্রস্তাব কার্যকর করতে রাজনৈতিক ইচ্ছা ও দৃঢ় পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ।