মঞ্চের সামনে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, অগণিত দর্শকের আনন্দ ধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ। মঞ্চে আলো-আঁধারের খেলা। এর মাঝে একজন হেঁটে হেঁটে মঞ্চে প্রবেশ করেন, তার হাতে ব্রিফকেস। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, হেঁটে আসা ব্যক্তিটি পপ সম্রাট মাইকেল জ্যাকসন।
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রিফকেসটি খুলেন মাইকেল জ্যাকসন। জ্যাকেট বের করে পরে নেন। এরপর সাদা রঙের একটি গ্লোভ বা হাতমোজা বের করে তা বাঁ হাতে পরেন। তারপর কালো রঙের হ্যাট মাথায় পরে নিয়ে আপন ভুবনে ডুব দেন। মাইকেল জ্যাকসনের লাইভ কনসার্টের ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ মাইকেল জ্যাকসনের গানের ভক্ত। সময়ের সঙ্গে তার সাজপোশাকও ট্রেন্ডে পরিণত হয়। এই কনসার্টে মাইকেল জ্যাকসন সাদা রঙের যে হাতমোজা পরেন তা ‘আইকনিক গ্লাভ’। কিন্তু এটি কেন ব্যবহার করতেন এই তারকা? এ প্রশ্ন অনেক মাইকেল ভক্তের।
ফ্যাশন সচেতন মাইকেল জ্যাকসন নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার অইকনিক সাদা রঙের হাতমোজা ফ্যাশনের চেয়েও বেশিকিছু ছিল। আর এর পেছনে রয়েছে অন্য গল্প। সহজে বললে, ভিটিলিগো বা শ্বেতী রোগে আক্রান্ত ছিলেন মাইকেল জ্যাকসন। এই চর্মরোগ ঢেকে রাখার বিশেষ কৌশল হিসেবে হাতমোজাটি ব্যবহার করতেন তিনি।
২০০৯ সালে সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দেন মাইকেল জ্যাকসনের চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আর্নি ক্লেইন। তিনি বলেন, ‘জ্যাকসন ভিটিলিগো বা শ্বেতী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এই রোগটির কারণে ত্বক পাতলা হয়ে যায়। একই সঙ্গে লুপাসের মতো ত্বকে ফুসকুড়ি সৃষ্টি করে। তার অবস্থা এতো খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, শরীরের নানা জায়গায় দাগ দেখা যাচ্ছিল। এটি তার পুরো শরীরেই ছিল। কিন্তু হাত ও মুখের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’
‘টার্নিং হোয়াইট’ নামে একটি স্মৃতিকথা লিখেন লি থমাস। আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে তার শারীরিক রোগ ও মানসিক সংগ্রামের বিষয়গুলো উল্লেখ করেন বইটিতে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় হাতাওয়ালা পোশাক পরতাম এবং ছাতা ব্যবহার করতাম। এটা আমাকে বেশ স্পর্শকাতর করে তুলেছিল। মূলত, ভিটিলিগোর কারণে আমার ত্বক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।’
থমাস, মিশিগানের ডেট্রয়েটের এমি অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত টেলিভিশন সাংবাদিক। সিএনএনে তিনি জ্যাকসনের একটি অভ্যাসের কথা শেয়ার করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার একটি হাতে সাদা স্পট ছিল। এজন্য মাইক্রোফোন ধরার সময় হাতমোজা ব্যবহার করতাম।’
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জেমস নোল্যান্ড। তিনি কখনো মাইকেল জ্যাকসনের চিকিৎসা করেননি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘এক গায়ক ভিটিলিগো রোগের সঙ্গে মিল রেখে হাতমোজা ও লিপস্টিক ব্যবহার করতেন। কারণ ভিটিলিগো রোগের চিহ্ন প্রথমদিকে সাধারণত হাত, মুখ ও ঠোঁটে দেখা যায়।’
মাইকেল জ্যাকসনের চিকিৎসক আর্নি ক্লেইন জানিয়েছিলেন, সে একটি ক্রিমের মাধ্যমে জ্যাকসনের ভিটিলিগো রোগের চিকিৎসা করেছিলেন। এ ক্রিম শ্বেতী রোগের দাগ দূর করে স্বাভাবিক ত্বক তৈরি করে। এটা এমন এক চিকিৎসা ছিল যে, এটি জ্যাকসনের গায়ের রং সাদা করবে না। বরং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করবে।
মাইকেল জ্যাকসন তার গায়ের রং নিয়ে গর্বিত ছিলেন। তা উল্লেখ করে ডা. আর্নি ক্লেইন বলেন, ‘মাইকেল জ্যাকসন কালো ছিলেন। সে তার গায়ের কালো রং নিয়ে গর্বিত ছিলেন।’
মাইকেল জ্যাকসনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অভিনেত্রী ব্রুক শিল্ডস। মাইকেল জ্যাকসনের এক স্মরণসভায় কথা বলতে গিয়ে তার হাতমোজার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘সে যখন হাতমোজা পরা শুরু করে, তা দেখে আমি পছন্দ করেছিলাম।’ ‘হাতমোজার কী খবর?’ এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন জ্যাকসনকে। এসময় দর্শকরাও হেসে ওঠেন। পরিস্থিতি সামলে আবার বলতে শুরু করেন ব্রুক। তিনি বলেন, ‘আমি পছন্দ করেছিলাম। আপনি যদি আমার হাত ধরতে চান, তাহলে হাতমোজা না থাকাই ভালো।’
১৯৫৮ সালের ২৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন মাইকেল জ্যাকসন। ২০০৯ সালের ২৫ জুন মারা যান এই বরেণ্য শিল্পী। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর অর্থাৎ নভেম্বর মাসে সাদা রঙের হাতমোজাটি নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়।
রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ৩ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে মাইকেল জ্যাকসনের বিখ্যাত সেই সাদা গ্লাভ; যা ধারণার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে।