৯০ দশকে ৪০ বিঘার পেঁপে বাগান করে সারাদেশে সাড়া জাগিয়েছিলেন চাষি শাহজাহান আলী বাদশা ওরফে ‘পেঁপে বাদশা।’ এ বছর তিনি জিরা চাষ করে সফল হয়েছেন। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর গ্রামে তার খামারে জিরা ফসলের পরীক্ষামূলক চাষ করেন। উচ্চমূল্যের এ মশলা চাষে সফল হওয়ায় তিনি খুশি। আগামী বছর পাবনায় কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে জিরা চাষ সম্প্রসারণ করার কথা জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জিরা সাধারণত শীতকালীন ফসল। জিরা চাষের জন্য উপযুক্ত হলো উঁচু ও চরাঞ্চল এলাকার জমি। চরাঞ্চলের মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি হওয়ায় পানি ধরে রাখতে পারে না।
তারা জানান, প্রতি বিঘায় এক কেজি জিরার বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের ১০৫-১১০ দিন পর জিরা পাওয়া যায়। ফলন পাওয়া যায় বিগা প্রতি আড়াই মণ। বর্তমান বাজার ৮ থেকে ১২শ’টাকা কেজি দরে জিরা বিক্রি হয়। সেই অনুযায়ী এক বিঘা থেকে ১ লাখ টাকারও ওপরে জিরা বিক্রি করতে পারবেন কৃষকরা। জিরা চাষ অন্যান্য ফসলের চেয়ে অনেক লাভজনক বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানান।
কৃষি কর্মকর্তারা আরো জানান, জিরা যদিও এ দেশের প্রচলিত ফসল নয় তবু চেষ্টা চলছে এই দেশের জলবায়ুতে এই ফসল উৎপাদন করার। দেশে বৃহৎ পরিসরে জিরা চাষের সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। শিগগিরই কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে জিরা উৎপাদন শুরু হবে।
জিরাগাছ সাধারণত ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। প্রধান কান্ডের ওপর আরো তিন থেকে পাঁচটা প্রধান প্রাথমিক শাখা বের হয়, যেখান থেকে আবার দুই থেকে তিনটা মাধ্যমিক শাখা উৎপন্ন হয়। সাধারণত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরে জিরার বীজ বপন করা হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে, তখন ফুল ফোটা ও বীজ গঠন সম্পন্ন হয়। ৮০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে জিরা পরিপক্ব হয়।
চাষ পদ্ধতি সম্বন্ধে কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা জানান, জিরা চাষের জন্য ভালোভাবে জমি চাষ করতে হয় যাতে মাটি ঝুরঝুরে হয়। এরপর জমিতে ছত্রাকনাশক দিতে হয়। প্রতি বিঘা জমিতে এক কেজি জিরা বুনতে হয়। লাইন করে জিরা বপন করা যায়। বপনের পর হালকা সেচ দিতে হয়। এরপর আবহাওয়া ও মাটির অবস্থা অনুসারে সেচ দিতে হবে। জমিতে পরিমাণমতো সারও দিতে হবে।
তিনি জানান, ফুল ফোটার সময় জিরা ফসলে রোগের আক্রমণ শুরু হয়। তবে ছত্রাকনাশক ৩ বীজে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে এই রোগের আক্রমণ কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত জিরা শস্য ৮০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পরিপক্ব হয়।
কৃষক শাহজাহান আলী বাদশা জানান, মসলা গবেষণার সহায়তায় তিনি ২৫০ গ্রাম জিরার বীজ পেয়েছিলেন। তার জিরা পরিপক্ক হয়েছে বলে জানান। নিয়ম মেনে সেচ, সার প্রয়োগ ও সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে ফলন পেয়ে তিনি খুশি।
তিনি আরো বলেন, যেভাবে সরিষার চাষ করা হয় একই রকমভাবে জিরা চাষ করেছি। গাছে যতগুলো ফুল; ততগুলোই জিরা ধরছে। বাজারে দাম ভালো থাকায় জিরা চাষ একটি লাভজনক ফসল মনে হয়েছে। বীজ বপণের ৩ থেকে সাড়ে তিন মাস সময় লাগে জিরা ঘরে উঠতে। এবছর পরীক্ষামূলকভাবে জিরা চাষ সফল দাবি করে আগামীতে আরো বড় পরিসরে জিরা চাষাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে তার।
বাদশা মিয়ার খামারে সার্বক্ষণিক কাজ করা কেয়ার টেকার রহিবুল ইসলাম জানান, জিরা চাষে বাড়তি একটু পরিচর্যা করতে হয়। তবে তা খুব কঠিন কাজ নয়। কৃষকরা সহজেই এর চাষ করতে পারে।
স্থানীয় এক চাষি আব্দুর রউফ জানান, বাদশা মিয়া নতুন ফসল জিরা চাষ করেছেন। জিরা চাষ আমরা আগে কখনো দেখিনি। খুব সুন্দর হয়েছে জিরার প্রজেক্ট। বাজারে জিরার দাম ভালো রয়েছে। চিন্তা করছি তার দেখাদেখি আমরাও জিরা চাষ করবো এবং জিরা চাষ করে লাভবান হবো। জিরার এমন ভালো ফলনে খুশি এলাকার অন্য কৃষকেরাও।
প্রথমবারের মতো জিরা চাষে সার্বক্ষণিক পরামর্শ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছেন বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার।
তিনি বলেন,মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওয়ায় মসলা জাতীয় ফসল হিসেবে কৃষক পর্যায়ে পরীক্ষামূলক জিরা চাষ বেশ ভালো হওয়ায় আমরা আশাবাদী। এ এলাকার মাটি ও আবহাওয়া জিরা চাষের উপযোগী হওয়ায় আগামীতে কৃষক পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে জিরা চাষ সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পাবনার উপ-পরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন জানান, জিরা একটি অতি মূল্যবান এবং চ্যালেঞ্জিং মসলা জাতীয় ফসল। জিরা চাষে একটু বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। এ বছর স্বল্প পরিসরে জিরার চাষাবাদ হলেও প্রদর্শনী থেকে উৎপাদিত জিরা বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আগামী মৌসুমে এর আবাদ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
তিনি বলেন, দেশে প্রতিবছর মসলাজাত পণ্য জিরার চাহিদা থাকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, যার সম্পূর্ণটাই আসে বিদেশ থেকে। এই পরিমাণ জিরার বর্তমান বাজার অনুযায়ী আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। কৃষক পর্যায়ে মসলা জাতীয় ফসল জিরা চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে ধীরে ধীরে জিরা উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হবে। আমদানির পরিমাণ কমে যাবে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।