বাংলা গানের জীবন্ত কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে ‘গানের পাখি’ বলেই ডাকা হয় তাকে। সুরের জাদুতে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন।
১৯৫৪ সালর ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম। বাবার চাকরির সুবাদে বেড়ে উঠেছেন নারায়ণগঞ্জে। তার পৈতৃক বাড়ি সাতক্ষীরায়। পরিবারে সংগীতের চর্চা ছিল, তাই ছোটবেলা থেকেই গানের সঙ্গে তার সখ্য। পাঁচ বোনের মাঝে চার বোনই গান করেছেন। এই গানের মানুষ আজ ৭১ বছর পূর্ণ করলেন।
এক জীবনে অনেক কিছুর সাক্ষী সাবিনা ইয়াসমিন। জীবন থেকে অনেক কিছু শিখেছেন এই শিল্পী। জীবনের কোন মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয় শিল্পীর কাছে। জবাবে সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, “সত্যি বলতে আমার সংগীতজীবনে কঠিন মুহূর্ত আসেনি। আল্লাহর রহমতে খুব ভালোভাবে এত দূর এসেছি, এতটা সময় কাটিয়েছি। মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন কিছু মুহূর্ত যে আসেনি, তা নয়। ওই সময়টায় গানই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গান আমার আনন্দ, দুঃখ, জীবন—সব।”
সাবিনা ইয়াসমিনের বাবা রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। তার মা মুর্শিদাবাদে সে সময়ের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও ওস্তাদ কাদের বক্সের কাছে গান শিখতেন। তার বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন ও ফৌজিয়া ইয়াসমিন দুর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেন। সাবিনা ইয়াসমিন ও নীলুফার ইয়াসমিন তাদের সঙ্গে বসতেন। তার মা তাকে তালিমে সহায়তা করতেন, হারমোনিয়াম বাজিয়ে সঙ্গ দিতেন। মাত্র সাত বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে গান করেন। পরবর্তীতে ওস্তাদ পি সি গোমেজের কাছে টানা ১৩ বছর শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন সাবিনা ইয়াসমিন। ১৯৬৪ সালে বেতারে ছোটদের গানের অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এ অংশ নেন সাবিনা ইয়াসমিন। এ অনুষ্ঠানে তার প্রথম সম্মানী ছিল ১০ টাকা।
সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন তার প্রতিবেশীর বাড়িতে আলতাফ মাহমুদ আসেন। ওই সময়ে আলতাফ মাহমুদ চলচ্চিত্রে সংগীতায়োজন করতেন। সাবিনা ইয়াসমিনের মা আলতাফ মাহমুদকে অনুরোধ করেন, মেয়েকে চলচ্চিত্রের গানে সুযোগ দেওয়ার। পরে আলতাফ মাহমুদ ‘আগুন নিয়ে খেলা’ (১৯৬৭) চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ করে দেন। এটি ছিল সাবিনা ইয়াসমিনের প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক। সিনেমাটি পরিচালনা করেন আমজাদ হোসেন।
পরবর্তী চার দশকে রীতিমতো দাপটের সঙ্গে গান করেন সাবিনা ইয়াসমিন। সংখ্যা কিংবা জনপ্রিয়তা দুই দিক দিয়েই বরাবরই এগিয়ে ছিলেন তিনি। সংগীত ক্যারিয়ারে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছে—‘তুমি আমার মনের মানুষ’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘কী দিয়া মন কাড়িলা’, ‘ও সাথীরে’, ‘এ জীবনে যারে চেয়েছি’, ‘তুমি যে আমার’, ‘সে যে কেন এলো না’, ‘তুমি চাঁদের জোছনা নও’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘কী জাদু করিলা’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’, ‘এই পৃথিবীর পরে’ প্রভৃতি।
তা ছাড়া দেশাত্মবোধক গান কণ্ঠে তুলে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তার গাওয়া কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে রয়েছে—‘জন্ম আমার ধন্য হলো’, ‘সব কটা জানালা’, ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ’, ‘একটি বাংলাদেশ’, ‘মাগো আর তোমাকে’ প্রভৃতি।
দীর্ঘ সংগীত ক্যারিয়ারে কত হাজার গান কণ্ঠে তুলেছেন তার সঠিক হিসাব করা মুশকিল। এর সঠিত তথ্য সাবিনা ইয়াসমিন নিজেও দিতে পারেন না। তবে ধারণা করা হয়— দশ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। দেড় হাজারের অধিক চলচ্চিত্রের গান কণ্ঠে তুলেছেন এই শিল্পী।
ভারতীয় উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার আর. ডি. বর্মণের সুরে গান করেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। কিশোর কুমার, মান্না দের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন তিনি। আবার মরমী শিল্পী আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের উঠতি শিল্পীদের সঙ্গেও গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন।
সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পদক এবং ১৯৮৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন সাবিনা ইয়াসমিন। বাংলা চলচ্চিত্রের গান গেয়ে গায়িকা হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি। এ পর্যন্ত চৌদ্দবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন এই শিল্পী।
Priyo Bangla 24 – Most Popular Bangla News The Fastest Growing Bangla News Portal Titled Priyo Bangla 24 Offers To Know Latest National And Local Stories.