এ যেন নাটক-সিনেমার কোন দৃশ্য! দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা। দেখা হতেই চিৎকার করে বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়লেন সন্তান। দেশে ফেরার পর যে মানুষটি পরিবারই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় তার পরিবারের সন্ধান মিললো।
চট্টগ্রাম থেকে গতকাল বুধবার তারা ঢাকায় এসে পৌঁছান। এরপর বিকেলে আবুল কাশেম নামের ওই বৃদ্ধকে তার পুত্র ও কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান। বিকেলে তারা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
এ সময় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার মোঃ রাসেল তালুকদার, সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান রনি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক মোঃ ফখরুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
গত শুক্রবার দিবাগত রাতে সৌদি আরব থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন এই বৃদ্ধ। কিন্তু তিনি নিজের ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। তার কাছে পাসপোর্টও ছিলো না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছেন। এরপর বিমাবন্দরের পুলিশ তাকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে পাঠায়। তার খোঁজ পেতে ব্র্যাকের কর্মীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর শুরু করে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি জানানো হয়। এরপর চট্টগ্রামের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়রের সহায়তায় তার পরিবারের সন্ধান মেলে।
হস্তান্তরের আগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান জানান, বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশসহ সবার সহযোগিতায় বিদেশফেরতদের জন্য আমরা নানান ধরনের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এরই অংশ হিসেবে বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি ও মাইগ্রেশন পুলিশ শনিবার বিকেলে ওই বৃদ্ধকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে দেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী এই বৃদ্ধ সম্ভবত শুক্রবার দিবাগত রাতে জেদ্দা থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছেন। তাঁর কাছে কোন পাসপোর্ট ছিল না। তিনি ট্রাভেল পাস নিয়ে এসেছেন।
শরিফুল হাসান জানান শারিরীকভাবে সুস্থ মনে হলেও সম্ভবত তিনি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত। এ কারণেই তিনি সঠিকভাবে তাঁর ঠিকানা বলতে পারছেন না। তিনি জানাচ্ছেন তার নাম আবুল কাশেম। পিতার নাম ফজেল আহমেদ। মাতা সাবানা। স্ত্রীর নাম বলছেন আমেনা। নিজের ঠিকানা তিনি কখনো বলছেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার। কখনো বলছেন টেকনাফ। আবার কখনো রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের গরিশংকরহাটের কথাও বলছেন। আবার বলছেন, চট্টগ্রামের নতুন বাজার হালিশহরের কাছে, ঈদগাহের মাঠ বউ বাজার এলাকায় তার ছেলের তরকারির দোকান আছে। আমরা তার বাড়ি কোথায় নিশ্চিত হতে না পারলেও ভাষা শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
আবুল কাশেম দাবি করছিলেন, তার ৬ মেয়ে ও ৩ ছেলে রয়েছে। তার তিন ছেলের নাম মান্নান, নূর হাসান, এনামুল হাসান। এর মধ্যে নূর হাসানের তরকারির দোকান আছে। ছোট ছেলে এনামুল হাসান দুবাই থাকেন। মান্নান সৌদি থাকেন বলে দাবি তার। ৮-১০ জন নাতি নাতনি আছেন। কিন্তু যেহেতু দীর্ঘ ২৫ বছর দেশে নেই সঠিকভাবে সব বলতে পারছিলেন না। তবে যেহেতু তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলছিলেন কাজেই আমরা চট্টগ্রামের পুলিশসহ নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা তার পরিবারের সন্ধানে গণমাধ্যম কর্মীদের সহায়তা চাই। অনেকেই তার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এরপরও আমরা পরিবারের সন্ধান পাচ্ছিলাম না।
শরিফুল হাসান জানান, ওই বৃদ্ধ কখনো চট্টগ্রামের হালিশহর, কখনো হাটহাজারী, নয়াবাজারসহ বেশ কিছু ঠিকানা বলছিলেন। তিনি যখন যেসব এলাকার কথা বলছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কর্মীরা সেসব এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। ওই বৃদ্ধ বলছিলেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার এলাকায় তার ছেলে তরকারি বিক্রি করে। সেই কথার উপর ভিত্তি করে আমাদের চট্টগ্রাম টীম “পরিবারের সন্ধান চাই” শিরোনামে ছবিসহ শত শত পোস্টার বিলি করে বেড়ায়। চট্টগ্রামের শহরের হালিশহর, নয়াবাজার, বউবাজার, ঈদগাহ, পাহাড়তলী সহ আরো বেশ কয়েকটি স্থানে দেয়ালে দেয়ালে আমরা পোস্টার লাগান। আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার সহযোগিতায় আমরা তার পরিবারকে খুঁজে বের করবোই।
শরিফুল হাসান জানান, এসব পোস্টার দেয়ালে লাগানো ও বিতরণ করার পর মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র (২৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর) আব্দুস সবুর লিটন যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, পোস্টারের ছবির লোকটিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এরপর আমাদের লোকজন তার অফিসে যায়। তার সহযোগিতায় আমরা তার ছেলে সবজি ব্যবসায়ী জনাব নূর হাসানের খোঁজ পাই। পরবর্তীতে কাউন্সিলর অফিসে তাকে এনে কথা বলে জানতে পারি আবুল কাশেম তার বাবা। তার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেও আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। নুর হাসানের কাছ থেকে আমরা পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলি। দুবাইতে থাকা তার এক ছেলের সঙ্গেও কথা বলি। এরপর বৃদ্ধ আবুল কাশেমের ছোট মেয়ে রুমা বেগম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগমের সাথে ঢাকা থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দেই। এ সময় যে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেটি ভাষায় বলা কঠিন। এরপরই আমাদের লোকজনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিতে ঢাকায় রওয়ানা হন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিদেশ ফেরত আবুল কাশেমের বড় ছেলে নূর হাসান। তিনি তার বাবাকে ফিরে পেয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ব্র্যাকসহ আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। অনেকদিন ধরে বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমরা জানতাম না তিনি সৌদি আরবের কোথায় আছেন। তিনি যে দেশে এসেছেন সেটাও আমরা জানতাম না।