শোক দিবস ও ছুটি থাকবে কিনা যা জানা গেল

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি বাতিলের পরামর্শ দিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ১৫ আগস্ট জমায়েত হলে শেখ হাসিনার দলকে প্রতিহত করবে অভ্যুত্থানকারীরা। আলাদা বৈঠক থেকে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনের যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে দলগুলো। উপদেষ্টাদের কথা কম বলে দ্রুততম সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সম্পন্নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একটি দলের সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা পরিষ্কার করেছেন, তিনি ২০০৮ সালের মতো এবারও ক্ষমতা নিতে আগ্রহী ছিলেন না। শিক্ষার্থীর অনুরোধে এসেছেন। ছাত্র-জনতার কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্পন্ন করার আগে নির্বাচনের চাপ দিলে তিনি দায়িত্বে থাকতে চান না।

গতকাল সোমবার বিকেল ৪টায় যমুনায় ড. ইউনূস বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করেন। এরপর একে একে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, বিজেপি, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনডিএম নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।

ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়। তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানিয়ে মৌন মিছিল করতে বলেছেন– এমন একটি ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে।
এ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সেদিন জমায়েত হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করবে বলে ধারণা থেকে অভ্যুত্থানে শরিক রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, ছাত্র-জনতার বিজয় নস্যাতের চক্রান্ত চলছে। এ পরিস্থিতিতে গতকাল ড. ইউনূস ১৫ আগস্টের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চান। একমাত্র বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ১৫ আগস্ট পালনের পক্ষে মত দেন। তিনি বলেছেন, ১৫ আগস্ট সর্বজনীন। যতটুকু শ্রদ্ধা পাওয়া উচিত, ততটুকু শ্রদ্ধাই যেন পায়। উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক বক্তব্য থেকে বিরত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার বৈঠকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানসহ নানা ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আলোচনা করেন বিএনপি নেতারা। সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মূল দাবি রাষ্ট্র সংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নিজস্ব এজেন্ডায় ১৫ আগস্টে জাতীয় শোক দিবস পালন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। নতুন করে রাষ্ট্র বিনির্মাণে দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাঠামোকে সংস্কার, আইনের শাসন এবং জনগণের অধিকারের দিকে মনোযোগী হতে সরকারপ্রধানকে পরামর্শ দেয় বিএনপি।

বৈঠকে বিএনপি নেতারা জানান, পরাজিত শক্তি দেশি-বিদেশি দোসর নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। সংখ্যালঘুদের নিয়ে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত চেষ্টায় সংখ্যালঘুর সম্পদ, মন্দির রক্ষা করা হয়েছে। কেউ যাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, কঠোরভাবে দুষ্কৃতকারী দমন করতে হবে।

বৈঠকে ভারতের অবস্থান নিয়েও আলোচনা করেন বিএনপি নেতারা। সেখানে বলা হয়, ভারত আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বাইরে যেতে পারছে না। কূটনৈতিক তৎপরতায় এ বিষয়ে ভারতকে অবহিত করার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।

শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন স্থানে বিএনপি নেতারা দখল, লুটপাটে জড়াচ্ছে– এ প্রসঙ্গও উঠে আসে বৈঠকে। বিএনপি নেতারা ড. ইউনূসকে জানান, সতর্ক করার পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, পালিয়ে ভারত গিয়ে জনগণের বিজয়কে নস্যাতের চক্রান্ত করছেন শেখ হাসিনা। সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতনের গল্প ফেঁদেছেন। খুব দুর্ভাগ্যজনক, এত হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের পরও আওয়ামী লীগ নানা রকম কথা বলছে, যা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার অবশ্যই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলবে; কিন্তু কোনো হত্যাকারীর সঙ্গে নয়। যারা ছাত্র, শিশু, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করেছে, জনগণ তাদের বিরুদ্ধে। অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করা প্রত্যেক দেশপ্রেমিকের কর্তব্য।

এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন নিয়ে কথা বলিনি। আগেও বলেছি, নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে সময় লাগবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সেটুকু সময় অবশ্যই দিতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, জনগণের নিরাপত্তাকে অক্ষুণ্ন রাখতে সরকারকে পুরোপুরি সহযোগিতা করছি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী কী করা যায়– তা প্রধান উপদেষ্টাকে বলা হয়েছে। সরকার কী কী করতে চায়, বিএনপিকে জানিয়েছেন তিনি।
বৈঠকে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটি সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও সেলিমা রহমান।

সংখ্যালঘু নিপীড়ন তদন্তে কমিশন চায় জামায়াত
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে দলটির ১১ প্রতিনিধি ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের পর জানান, সংখ্যালঘুর ওপর কতটা নির্যাতন হয়েছে, তা তদন্তে কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রয়োজনে একজন হিন্দু বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন হবে। কমিশন দেখবে, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার কতটা রাজনৈতিক আর কতটা সাম্প্রদায়িক। ভারতীয় গণমাধ্যমে জামায়াতের নাম নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তবে ভারতেই এর প্রতিবাদ হচ্ছে। কারণ, জামায়াত হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষা করছে।

নির্বাচন প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, মাত্র চার দিন হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। দেখতে চাই তারা কীভাবে এগোবে। সংস্কারের জন্য তাদের যৌক্তিক সময় দিতে চাই।

গত ১ আগস্ট জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করেছিল তৎকালীন হাসিনা সরকার। নিষিদ্ধ দল হয়ে কীভাবে সরকারি বৈঠকে থাকছেন– প্রশ্নে জামায়াত আমির বলেন, কেউ বললেই জামায়াত নিষিদ্ধ হয়ে যায় না। আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা জনগণ গ্রহণ করেনি।

১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেননি শফিকুর রহমান। সেদিন আওয়ামী লীগের জমায়েত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র জনগণই প্রতিহত করবে।
জামায়াতের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের নায়েবে আমির ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা।

প্রাশাসনিক সংস্কারের পরামর্শ
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হককে পাশে নিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেছেন, জনগণ এখন শত শত শহীদের শোকে বিহ্বল। এ সময়ে এমন কিছুই করা উচিত হবে না, যা উস্কানি দেবে। বিশেষ করে, তিনি প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টাকে। তিনি জানিয়েছেন, পুলিশ বাহিনী খুবই অনুতপ্ত। যত শিগগির সম্ভব পুলিশ কাজে যোগ দেবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের জানান, অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করে ষড়যন্ত্র মোকাবিলার কথা বলেছেন তারা। যে সম্প্রীতি দেখা গেছে, তা যেন কেউ নষ্ট করতে না পারে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সব হত্যার বিচার করার দাবি করেছেন। সংবিধান সংস্কারের পর আগামী নির্বাচনের ধরন কী হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সূত্রপাতের কথা বলেছেন তারা।

সরকারে রাজনৈতিক নেতা নেওয়ার প্রস্তাব
অন্তর্বর্তী সরকারে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের নেতাদের শামিল করার প্রস্তাব করেছে গণঅধিকার পরিষদের একাংশ। দলটির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ফারুক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার অধীনে ২৫টি মন্ত্রণালয় রয়েছে। তাঁকে বলেছি, আপনি তিনটি মন্ত্রণালয় নিজের কাছে রেখে, বাকিগুলোতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপদেষ্টা নিয়োগ করুন।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রস্তাব
আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে হত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছেন বলে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা সমর্থনযোগ্য কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, জার্মানিতে নাৎসি, ইতালিতে ফ্যাসিস্টরা নিষিদ্ধ। ফ্যাসিবাদের কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা জনগণের দাবি।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্বীকৃতি, সব মামলা প্রত্যাহারসহ ১৪ দফা দাবি জানানো হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে।

নুরুল হক নুর জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস প্রতিহতে জনতার মঞ্চ তৈরি করে অবস্থান নেওয়া হবে। শেখ হাসিনার সহযোগী ওসি, ইউএনও, ডিসি, এসপিদের পরিবর্তন করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কোনো ব্যবসায়ীকে যেন হয়রানি করা না হয়। দ্রুত সময়ে সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছে।

ব্যক্তিপূজা বন্ধের প্রস্তাব
এবি পার্টির সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, পৃথিবীর কোথাও একজন ব্যক্তির জন্য মাসজুড়ে শোক পালন করা হয় না। আগস্ট আর শোকের নয়, বিপ্লবের মাস। কোথাও এক ব্যক্তির জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয় না। স্বৈরাচারের সবকিছু জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আগস্টের ছুটিও প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই ছুটি বাতিলের পক্ষে মতামত জানিয়েছি প্রধান উপদেষ্টাকে।

মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টাকে সতর্ক করেছেন, ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিণতি আওয়ামী লীগের চেয়েও খারাপ হবে।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল বিকেলে সাক্ষাৎ করেছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।