ওপার বাংলা যে ঘটনায় উত্তাল, কী ঘটেছিল সেই চিকিৎসক তরুণীর সঙ্গে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ১৩৮ বছরের পুরোনো আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা ঘিরে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশ থেকে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিলোপের লক্ষ্যে বুধবার ভারতের স্বাধীনতা দিবসের রাতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ পালন করেন দেশটির নাগরিকরা। ‌‘মেয়েরা রাত দখল করো’ নামের এই বিক্ষোভ কর্মসূচি ভারতজুড়ে পালন করে বিক্ষোভকারীরা। এর মধ্যে মধ্যরাতে কলকাতা শহরে মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্যানুযায়ী, কলকাতার একটি প্রথম সারির মেডিকেল কলেজের ওই চিকিৎসকের দেহের ময়নাতদন্তে চরম যৌন লাঞ্ছনার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এই অভিযোগ ওঠার পর সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কার্যত ফুঁসে উঠেছে।

কী হয়েছিল তরুণীর সঙ্গে?

গত বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) রাতে টানা ৩৬ ঘণ্টার ‘অন-কল’ ডিউটিতে ছিলেন তরুণী চিকিৎসক। রাতে প্যারিস অলিম্পিকে জ্যাভেলিন থ্রো’র ইভেন্ট টিভিতে দেখে এবং অনলাইনে আনানো খাবার সহকর্মীদের সঙ্গে খেয়ে চারতলার পালমোনোলজি বিভাগের সেমিনার হলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে যান তিনি।

পরদিন সকালে জুনিয়র সহকর্মীরা ওই হলের ভেতরেই তার অর্ধনগ্ন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। নিহত তরুণীর গোপনাঙ্গের পাশেই পড়ে ছিল মেয়েদের মাথার চুলের একটি ক্লিপ।

তরুণীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাদের প্রথমে জানিয়েছিল, তাদের মেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে। পরে অবশ্য তীব্র জনরোষ ও ক্ষোভের মুখে পুলিশ এই ঘটনায় ধর্ষণ ও হত্যার মামলা দায়ের করেছে।

আর জি কর মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনিও বিষয়টি আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, রাতের বেলা একা একা সেমিনার হলে গিয়ে মেয়েটি ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কাজ করেছে।

পরে আন্দোলনরত মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসকদের চাপে অভিযুক্ত ওই প্রিন্সিপাল গত সোমবার নিজের পদ ও সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কিন্তু এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে কলকাতাসহ সারা ভারতে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।

‘সহযোগী পুলিশকর্মী’ গ্রেফতার

হাসপাতালের সেমিনার হল থেকে ওই তরুণীর মরদেহ উদ্ধারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ মূল অভিযুক্ত সন্দেহে সঞ্জয় রায় নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে। তিনি কলকাতা পুলিশের ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ বা সহযোগী কর্মী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।

‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ হলো এমন একটি পদ, যা পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে রাজ্য সরকার চালু করেছে। এই পদধারীরা সরাসরি পুলিশ বা ট্র্যাফিক পুলিশের সদস্য না হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে তাদের সাহায্য করেন এবং বিনিময়ে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বেতন পান।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ধৃত ওই ব্যক্তির বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার এবং নির্যাতন ও চাঁদাবাজিতে যুক্ত থাকার অতীত ইতিহাস রয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, আর জি কর মেডিকেল কলেজে সেদিন রাতের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে চিহ্নিত করা হয়। ওই তরুণীর সঙ্গে যখন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তার ঠিক আগে ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ঢুকতে দেখা যায় এবং তার খানিকক্ষণ পরে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়।

তবে আন্দোলনরত চিকিৎসকরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলো বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও হাসপাতালের কোনো সিসিটিভি ফুটেজ পুলিশ প্রকাশ করেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, পালমোনোলজি বিভাগের ও সেমিনার হলের সিসিটিভি সেদিন কাজ করছিল না।

ধৃত সঞ্জয় রায় ২০১৯ সালে কলকাতা পুলিশের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। পরে রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি বদলি নেন কলকাতা পুলিশের ‘ওয়েলফেয়ার সেল’ বা কল্যাণ সমিতিতে, যার সুবাদে আর জি কর হাসপাতাল কমপ্লেক্সে তারা অবাধ যাতায়াত ছিল।

এমনকি, পুলিশ বাহিনীর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ওই ব্যক্তি থাকতেন কলকাতা পুলিশের ফোর্থ ব্যাটেলিয়নের চত্বরেই। চলাফেরা করতেন কলকাতা পুলিশের স্টিকার লাগানো একটি মোটরবাইকে।

কলকাতা পুলিশের কমিশনার বিনীত কুমার গোয়েলকে শনিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বারবার প্রশ্ন করা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ হিসেবে পুলিশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না অথবা নিয়োগের আগে তার ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করা হয়েছিল কি না, সে ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি।

‘প্রকৃত দোষীদের’ বিচারের দাবিতে আন্দোলন

নিহত ওই তরুণী চিকিৎসকের খুনী ও ধর্ষণকারীদের চরমতম শাস্তির দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতালে তার সহকর্মী জুনিয়র চিকিৎসকরা আন্দোলনে নেমেছেন গত শুক্রবার থেকেই। জরুরি বিভাগ বাদে হাসপাতালের বাকি সব বিভাগেই চিকিৎসকরা রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন। সর্বভারতীয় স্তরে চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-ও এই আন্দোলনে তাদের সংহতি জানিয়েছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকরা এই ঘটনায় ‘ফাস্ট ট্র্যাক বিচারবিভাগীয় তদন্ত’ চেয়েছেন, নিহতের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং কলকাতা পুলিশকে তাদের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে বলেও দাবি জানিয়েছেন।

আন্দোলনরত এক চিকিৎসক জানান, আমরা ঘটনার যে বিবরণ পেয়েছি তাতে এটি পরিষ্কার যে খুন ও ধর্ষণে একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিল। মাত্র একজনকে ধরা হলেও বাকিরা রাজনৈতিক প্রভাবশালী বলেই কি তাদের স্পর্শ করা হচ্ছে না?

আন্দোলনকারীরা আরো জানাচ্ছেন, নিহত ওই তরুণীর পোস্টমর্টেম ও অটোপসি রিপোর্টের কপি তাদের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তার স্টার্নাম, কলারবোনও পেলভিক জয়েন্ট ভেঙে গিয়েছিল। চোখ, মুখ ও যৌনাঙ্গ থেকে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছিল।

তরুণীর বাম পায়ে, ডান হাতে, ডান হাতের আঙুলে, ঘাড়ে ও ঠোঁটে মোট ১১টি ক্ষত ছিল। সারা শরীরে নির্যাতনের যে ধরনের লক্ষণ পাওয়া গেছে তা থেকেই তার সহকর্মীরা মনে করছেন, এই কাজ কিছুতেই একজন ব্যক্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়।

এই ঘটনায় ‘প্রকৃত দোষী’দের আড়াল করা হচ্ছে কি না, ধৃত সঞ্জয় রায় ছাড়া অন্য আরো কেউ এই অপরাধে যুক্ত কিনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও চলমান আন্দোলনে এসব প্রশ্ন তাই ঘুরেফিরেই আসছে।