১৯৩৯ সালে শুরু, একই নিয়মে তিন প্রজন্ম ধরে চলছে হোটেলটি

কাগজে-কলমে নাম ‘তাজ রেস্তোরাঁ’। তবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘মালেকের হোটেল’ নামে। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৮৩ বছর পার হলেও হোটেলটি এখনো আছে আগের মতোই। এখনো আগের সেই টিনের ছাউনিঘর।

মেঝে কাঁচা। দরজা-জানালা, খাবার টেবিল, ঘরের খুঁটি, চৌকাঠ—সবকিছুই কাঠের তৈরি। মাথার ওপর এখনো আছে পুরোনো দিনের হ্যাজাক বাতি ও বৈদ্যুতিক পাখা।

ঘরের ছাদে বাঁশের চাটাই। আর রান্নাবান্নার জন্য আছে মাটির চুলা। খাবার পরিবেশনে এখনো ব্যবহার করা হয় পুরোনো দিনের কাঁসার তৈরি জগ, চামচ, স্টিলের বাটি ও সিরামিকের প্লেট। এর মধ্যে পুরুষ ও নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা খাবারঘর।

রাজধানীর আবদুল্লাহপুর থেকে টঙ্গী সেতু পার হলেই হাতের ডানে বহুল পরিচিত টঙ্গী বাজার। এখানে বাজার মসজিদ সড়ক ধরে খানিকটা সামনে এগোলে ‘তাজ রেস্তোরাঁ’ বা মালেকের হোটেল। খাবারের মান, নিয়মশৃঙ্খলা, পরিবেশ ও পরিবেশনই প্রধান আকর্ষণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনো হোটেলটিতে ধরে রাখা হয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য।

গত রোববার বেলা দেড়টার দিকে মূল ফটকে যেতেই এগিয়ে এলেন একজন। গ্রাহক ভেবে অনেকটা অতিথি গ্রহণের মতো করে নিয়ে গেলেন মূল দরজা পর্যন্ত। এরপর ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল বিশাল খানাপিনার আসর। জনাপঞ্চাশেক মানুষ (ক্রেতা)। তাঁদের কেউ খাচ্ছেন, কেউবা খাবারের অপেক্ষায়। এর মধ্যে ক্রেতা, দোকানি ও পরিবেশনকারীদের ব্যস্ততায় সরগরম অবস্থা।

আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়ায় হোটেলটিতে ঢুকে দেখা হলো সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বের থাকা মো. আজাহারের সঙ্গে। কুশল বিনিময় শেষ হতেই বলে উঠলেন, ‘এটা আমাদের বহুদিনের পুরোনো হোটেল। দূরদূরান্তের মানুষজন খেতে আসেন এখানে। দিনের এ সময়টা (দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা) আমাদের রাস টাইম (ব্যস্ত সময়)।

তাই এখন সবাই কাজে ব্যস্ত।’ কথা বলার মাঝেই ডেকে নিলেন হোটেলটির প্রায় ২০ বছরের পুরোনো কর্মচারী মো. সাত্তারকে। এরপর তাঁর সঙ্গেই পুরো হোটেলটি ঘুরে দেখার আহ্বান তাঁর।

মালেক ওরফে আবদুল মালেক স্থানীয় বাসিন্দা। জীবিকার তাগিদে ১৯৩৯ সালে ছোট্ট পরিসরে হোটেলটি চালু করেন তিনি। এরপর চাহিদা বাড়ায় ১৯৪৭ সালের দিকে হোটেলটি বড় করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘তাজ রেস্তোরা’।

প্রায় ৪৫ বছর দোকান চালানোর পর ১৯৮৬ সালে মারা যান আবদুল মালেক। এরপর পর্যায়ক্রমে হোটেলটির হাল ধরেন তাঁর ছেলে আবদুল সাদেক ও স্ত্রী জায়েদা বেগম। তাঁদের মৃত্যুর পর ২০১৩ সাল থেকে হোটেলটির দেখাশোনা শুরু করেন মালেকের নাতি এম এ জুবায়ের। এখন তিনিই এর তত্ত্বাবধায়ক।

কর্মচারী মো. সাত্তার যখন হোটেলের পুরুষ কক্ষ বা মূল খাবার ঘরে নিয়ে গেলেন, ঘড়িতে তখন বেলা দুইটা বাজে। ভেতরে সুবিন্যস্ত পাঁচটি খাবার টেবিল। প্রতিটি টেবিলে চারজন করে খেতে বসেছেন। আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবার দিকে খেয়াল রাখছেন একজন পরিবেশক (মেসিয়ার)। তিনি প্রয়োজনে জগ থেকে পানি ঢেলে দিচ্ছেন। একই চিত্র দেখা গেল পাশের নারী কক্ষেও। এর মধ্যে যাঁরা ভেতরে জায়গা পাননি, তাঁরা অপেক্ষা করছেন বারান্দায়। সেখানেও বসার জন্য পাতা হয়েছে দুটি চৌকি।

সাত্তার বলছিলেন, হোটেলটি চালুর সময় যেভাবে মানুষদের খাওয়ানো হতো, এখনো সেই নিয়মই মেনে চলতে হয়। এখানে নিয়মশৃঙ্খলা সবার আগে। যত বড় ব্যক্তিই আসুক, ভেতরে জায়গা না থাকলে তাঁকে নিয়ম মেনে বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। এখানে সবাই সমান। একেকটা কাস্টমার (গ্রাহক) বহুদিনের পুরোনো।

খাবার ঘরের পাশেই রান্নাঘর। প্রশস্ত জায়গা নিয়ে পাতা হয়েছে চারটি বড় চুলা। এসব চুলায় চলছে ভাত ও বিভিন্ন তরকারি রান্নার কাজ। পাশেই ছিমছাম, পরিপাটি পরিবেশে পাতা কয়েকটি টেবিল। চুলা থেকে গরম ভাত, ভাজি বা অন্যান্য তরকারি উঠতেই রাখা হচ্ছে এসব টেবিলে। এরপর ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে গরম খাবার। এ ছাড়া পাশেই চলছে কাটাকাটি ও অন্যান্য কাজ। আর রান্নাবান্নার এই পুরো কাজ তদারক করেন জুবায়রের মা অযুফা সাদেক। তাঁর কাজে সহযোগিতার জন্য রয়েছেন দুজন বাবুর্চি।

স্বপন নামের একজন বাবুর্চির ভাষ্য, ’আমাদের এখানে সব খাবারই গরম। কাস্টমার চাওয়ামাত্রই আমরা চুলা থ্যাইকা ভাত–তরকারি তুলে দেই। খেয়ে তারাও আনন্দ পায়।’ তিনি জানান, হোটেলটিতে শুধু দুপুরের খাবার বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ লোক খেতে আসেন। খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, ভর্তা, মুরগি, খাসি ও মাছ। এ ছাড়া আছে খিচুড়ি ও বিরিয়ানি আইটেম।

পুরো হোটেল ঘুরতে ঘুরতে বেলা সাড়ে তিনটা। এর মধ্যেই যোগ দিলেন হোটেলটির বর্তমান মালিক এম এ জুবায়ের। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর আমি অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দাদি (জায়েদা) একা হোটেল সামলাতে পারছিল না। বেচাবিক্রিতে ঢাল দেখা দেয়। পরে বাপ-দাদার ব্যবসাটাকে টিকিয়ে রাখতে বিদেশে না থেকে দেশে চলে আসলাম।

এখন সবার চেষ্টায় হোটেলটি বেশ ভালোই চলছে।’ জুবায়ের আরও বলেন, ‘আমরা কখনোই এটাকে হোটেল মনে করি না। আমার দাদা বলতেন, এটা মেহমানখানা। দাদা দোকানে আসা প্রত্যেক কাস্টমারকে মেহমানের মতো আদর করে খাওয়াতেন, আমরাও এখনো সেভাবেই আচরণ করি।’

হোটেলটি থেকে বের হওয়ার পথে কথা হয় নগরের ছায়াবীথি এলাকার দম্পতি হালিমা ও তাঁর স্বামী পারভেজের সঙ্গে। তাঁরা টঙ্গীতে জমিসংক্রান্ত একটি কাজে এসে হোটেলটিতে দুপুরের খাবার খেতে আসেন। হালিমা বলেন, ‘হোটেলটির নাম অনেকের কাছেই শুনছি। তাই ইচ্ছা ছিল, কোনো কাজে টঙ্গী এলে খেয়ে যাব। এখানকার পরিবেশটা খুবই ঘরোয়া। খেয়ে ভালোই লাগছে।’